শাপলা নিয়ে ইসি-এনসিপির টানাপোড়েন কাটবে কবে?

এনসিপি তাদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের জন্য শাপলার এই ছবিগুলো উপস্থাপন করেছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মধ্যে 'শাপলা' প্রতীক নিয়ে টানাপোড়েন চলছে সেই জুন মাস থেকেই। একদিকে শাপলা জাতীয় প্রতীক হওয়ায় এ নিয়ে নানা নিয়ম দেখাচ্ছে ইসি। অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত এই প্রতীকটি না পেলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে এনসিপি।

বিষয়টি নিয়ে এনসিপি এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), অন্যান্য কমিশনার ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক চিঠি চালাচালি ও বৈঠক হলেও এখনো সমস্যার সমাধানে পৌঁছনো যায়নি।

এনসিপি তাদের দাবিতে অনড়। তারা বলছে, ইসি তাদেরকে অন্যায়ভাবে শাপলা প্রতীক দিচ্ছে না।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল বুধবার বলেন, 'আমাদের শাপলা প্রতীক না দিলে আমরা নির্বাচনে অংশ না-ও নিতে পারি।'তিনি আরও বলেন, 'যে কমিশন নিবন্ধন ও প্রতীক বণ্টনে ন্যায্যতা দেখাতে পারে না, তার কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।'

এদিকে ইসি বলছে, শাপলা জাতীয় প্রতীকের মূল উপাদান এবং আইন অনুযায়ী এটা নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে দেওয়া যায় না।

নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাপলা বাংলাদেশ জাতীয় প্রতীকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিয়মে স্পষ্টভাবে বলা আছে— জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা কমানো যাবে না। এমনটা করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।'

শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। এটি দেখা যায় দেশের মুদ্রায়, জাতীয় পরিচয়পত্রে, পাসপোর্টে, বিভিন্ন বাহিনীর প্রতীকে এবং সরকারি ভবনে।

তাহমিদা আহমদ বলেন, 'সর্বত্র ব্যবহৃত হলে এটাকে (শাপলা) নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে কীভাবে দেওয়া যায়? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি আমাদের অনুমোদিত প্রতীকের তালিকায় নেই। তালিকায় না থাকা কোনো প্রতীক আমরা দিতে পারি না। আগে আরও কয়েকটি দল শাপলা চেয়েছিল, তখনও দেওয়া হয়নি। এখন এনসিপিকে কীভাবে দেব?'

আগেও নাগরিক ঐক্য ও বাংলাদেশ কংগ্রেস 'শাপলা'প্রতীক চেয়েছিল।

জাতীয় প্রতীকে দেখা যায়— পানির ওপর ভাসমান শাপলা ফুল, দুই পাশে দুটি ধানের শীষ, শাপলা ফুলের ওপর তিনটি সংযুক্ত পাটপাতা এবং তার উভয় পাশে দুটি করে তারা।

বাংলাদেশ জাতীয় প্রতীকবিধি-১৯৭২ এর ৪ নং নিয়মে বলা আছে— জাতীয় প্রতীক একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ প্রতীক, যা শুধু নির্দিষ্ট স্থানে ব্যবহার করা যাবে।

এটি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের আসনের পেছনে ঝোলানো থাকবে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও সম্মেলন কক্ষে এটি প্রদর্শিত হবে।

রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা বা অনুষ্ঠানে, তাদের ব্যবহৃত যানবাহনে, সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির আসনের পেছনে এবং দূতাবাস বা হাইকমিশনে জাতীয় দিবসে এই প্রতীক প্রদর্শন করা যাবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি লেটারহেডেও এটি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।

৫ নং নিয়মে বলা আছে, সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। এটি কোনো ব্যবসা, ট্রেডমার্ক, ডিজাইন বা পেশাগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

এনসিপি ও ইসির পাল্টাপাল্টি চিঠি ও বক্তব্য

গত ২২ জুন এনসিপি তাদের নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেয় এবং তিনটি প্রতীক প্রস্তাব করে— শাপলা, কলম ও মোবাইল ফোন। পরে ৩ আগস্ট ও ২৪ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে তারা তাদের পছন্দ সংশোধন করে জানায়, তারা সাদা বা লাল শাপলা চায়।

৩০ সেপ্টেম্বর ইসি দলটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, অনুমোদিত প্রতীকের তালিকা থেকে একটি প্রতীক বেছে নিয়ে ৭ অক্টোবরের মধ্যে জমা দিতে হবে।

পরে আরেক চিঠিতে বলা হয়, ১৯ অক্টোবরের মধ্যে প্রতীক নির্বাচন করতে হবে। ওই দিন এনসিপি ইসির কাছে লিখিতভাবে জানতে চায়, কোন মানদণ্ডে প্রতীক তালিকায় রাখা হয় বা বাদ দেওয়া হয়।

এর আগে ৯ জুলাই ইসি সিদ্ধান্ত নেয়, নির্বাচন পরিচালনা বিধি অনুযায়ী শাপলা প্রতীক তালিকায় রাখা হবে না।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, 'আমরা নীতিগতভাবে ঠিক করেছি, শাপলা প্রতীক হিসেবে রাখা হবে না। কারণ এটি জাতীয় প্রতীকের অংশ।'

২৩ সেপ্টেম্বর কমিশন নির্বাচনী প্রতীকের সংখ্যা ৬৯ থেকে বাড়িয়ে ১১৫ করে, তবে শাপলা বাদ রাখে। এর মধ্যে ৫১টি নিবন্ধিত দলকে দেওয়া হয়, বাকিগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকে।

পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর এনসিপি চিঠি দিয়ে জানায়, কমিশনের যুক্তি 'আইনগতভাবে সঠিক নয়'। তাদের মতে, কমিশনের প্রত্যাখ্যানের কোনো আইনি ভিত্তি নেই।

চিঠিতে এনসিপি উল্লেখ করে, জাতীয় প্রতীকে শাপলা ভাসছে পানির ওপর, এর রং হলুদ ও লালচে।

দলটি আরও বলে, জাতীয় প্রতীকে চারটি ভিন্ন উপাদান রয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে 'ধানের শীষ' প্রতীক দিয়েছে বিএনপিকে এবং 'তারা' দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-রব)। যেহেতু এমন নজির আছে, ইসি শাপলাকেও তালিকাভুক্ত করে দিতে পারে।

ইসি ইতিমধ্যে জাতীয় ফল 'কাঁঠাল' দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির একাংশকে এবং 'সোনালি আঁশ (পাট)' দিয়েছে তৃণমূল বিএনপিকে।

এনসিপির যুক্তি, 'তাহলে শাপলা জাতীয় ফুল হলেও এটি প্রতীক হিসেবে রাখায় কোনো আইনগত বাধা নেই।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্বাচন কমিশনের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বিএনপির ধানের শীষ ও জাতীয় প্রতীকের ধান এক নয়। জাতীয় প্রতীকে দুইদিকে একক শীষ, আর বিএনপির প্রতীকে গোছা আকারে ধান রয়েছে। তাদের মধ্যে দৃশ্যগত পার্থক্য আছে।

২৪ সেপ্টেম্বরের চিঠির পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন প্রশ্ন তোলেন, 'নাগরিক ঐক্যের আবেদন যখন কোনো বিতর্ক ছাড়াই খারিজ হয়েছিল, তখন এনসিপির আবেদনে এত বিতর্ক কেন?'

তিনি বলেন, এনসিপি যদি নির্বাচন পরিচালনা বিধি সংশোধন করে শাপলা প্রতীক পেতে চায়, বিষয়টি কমিশন বিষয়টি সম্মিলিতভাবে বিবেচনা করবে।

গত ৯ অক্টোবর এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, 'আমাদের পছন্দের প্রতীক না পেলে আমরা নিবন্ধন নেব না। এখন ইসির সামনে দুটি বিকল্প— হয় ধান, তারা ও সোনালি আঁশ প্রতীকগুলো বাতিল করুক, নয়তো শাপলা দিক। আমরা কারও প্রতীক বাতিল চাই না।'

নাম জানাতে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, '২০০১ সালের আগ পর্যন্ত সাধারণত ইসি নির্বাচনের আগে প্রতীক বণ্টনের দিন দলগুলোর সঙ্গে বসত। তখন আগের নির্বাচনে ব্যবহৃত প্রতীকই দলগুলোকে দেওয়া হতো।'

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ইসি দল নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু করে এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধি-২০০৮ অনুযায়ী নিবন্ধিত প্রতিটি দলকে নির্দিষ্ট প্রতীক দেয়। অন্য প্রতীকগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে।

তিনি আরও জানান, বিএনপি প্রথম 'ধানের শীষ' প্রতীক ব্যবহার করে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতীক হয়। তার প্রশ্ন— এত পুরনো বিষয়ে এখন প্রশ্ন তোলার মানে কী?

নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'শাপলা নিয়ে বিষয়টি নতুন করে উঠেছে, তাই কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। শাপলাই জাতীয় প্রতীকের মূল উপাদান। বাকি অংশগুলো সাজসজ্জার জন্য। প্রতীকের ভিত্তি হচ্ছে শাপলা।'

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা বলেন, 'আমরা শাপলা চাই, কারণ এটি জনগণের কাছে খুব পরিচিত প্রতীক। জুলাই মাসে আমাদের গণমিছিলগুলোতে শাপলা নিয়ে মানুষ উৎসাহ দেখিয়েছে। তাই আমরা মনে করি, এই প্রতীক ব্যবহার করলে জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আরও শক্তিশালী হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Council of Advisers approve six ordinances, including Labour and RPO

Also cleared proposals to simplify housing services and establish a new consulate general office in Detroit, US

27m ago