ডেঙ্গু: মানুষকে বিপদের মধ্যে রেখে অভিভাবকরা কেন বিদেশে

কোলে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে মানুষ ছুটছে পাগলের মতো। হাসপাতালে জায়গা নেই, জায়গা পেলেও সাংঘাতিক রকম চাপ, রক্ত জোগাড় করা আরও কঠিন। চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারও প্রতিদিনই বাড়ছে।

এই তো সেদিন ১০ মাস বয়সী রাজশ্রী চলে গেল। তাকে হারিয়ে মা-বাবা পাগলপ্রায়। শুধু রাজশ্রী নয়, ডেঙ্গুতে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। শিশুরা আক্রান্তও হচ্ছে বেশি এবং আক্রান্ত হওয়া মাত্রই অনেকের খিঁচুনি হচ্ছে, দ্রুত অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, প্লাটিলেট কমছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত শয্যা সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

বিপুল রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক আর নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। এই কারণে ভালো চিকিৎসার পরিবেশ বজায় রাখাই কষ্টকর হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়ার তথ্য অনুযায়ী, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানির রেকর্ড। ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একদিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এত মানুষ মারা যায়নি।

দেশের এই পরিস্থিতির মধ্যেই পরিবার নিয়ে অবকাশ কাটাতে গেছেন স্বাস্থ্যখাতের প্রধান, অর্থাৎ আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পুরো দেশ যখন ডেঙ্গু আতঙ্কে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন বর্তমান পরিস্থিতিকে পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি বলে আখ্যা দিচ্ছেন, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অবকাশ কাটাচ্ছেন মালয়েশিয়ায়। কীভাবে ওনার ইচ্ছে হলো দেশের মানুষকে মৃত্যুমুখে রেখে মালয়েশিয়াতে বেড়াতে যাওয়ার? আর ইচ্ছা যদি হয়েও থাকে, ছুটি মিললো কীভাবে? দেশে যখন কোনো সেক্টরে বিপদ দেখা দেয়, তখন সেই সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিতদের ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। অথচ এই আপদকালীন সময়ে সেই দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী মালয়েশিয়ায় বেড়াতে চলে গেলেন!

এর আগেও যে বছর দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর রেকর্ড হয়, সে বছরও ঠিক এই সময়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে খবরে প্রকাশ হয়। পরে জানা গিয়েছিল, সেসময়েও পারিবারিক অবকাশে তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। বর্তমানে মন্ত্রী মহোদয় কোথায় আছেন, জানতে চাইলে তার ব্যক্তিগত সহকারী রিয়াজুল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, 'স্যার বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন'। কোথায় আছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'মালয়েশিয়ায়'। তিনি কি অফিশিয়াল নাকি ব্যক্তিগত কাজে গেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'তিনি ফ্যামিলি ট্রিপে আছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে গত ১২ জুলাই এক সপ্তাহের ট্যুরে গেছেন।'

চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে বলে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু সেই তথ্য নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি। মাথাব্যথা নেই বলেই হয়তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন দেশের বাইরে যান, তখন থেকেই ডেঙ্গুর একেবারে পিক টাইম শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার ঠিক আগের দিন (১১ জুলাই) চলতি বছরে প্রথমবার এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা হাজারের ঘর পার হয়। এমনকি মন্ত্রী যেদিন (১২ জুলাই) দেশের বাইরে যান, সেদিন রোগীর চাপের কারণে ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড করে দিয়েছে।

তবে শুধু যে ডেঙ্গুরই পিক টাইম তা তো নয়, দেশে চলছে সরকারি-বেসরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসকদের ভাতা বাড়ানোর আন্দোলন, সেন্ট্রাল হাসপাতালের ২ চিকিৎসকের কারাগারে থাকা নিয়েও তখন ধর্মঘট চলছিল। যার পরামর্শ ও নির্দেশনা মেনে ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ চলা উচিত, তিনি নিজেই বিপদ এলাকার বাইরে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন।

শুধু মন্ত্রী মহোদয় নন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ১৭ দিনের জন্য গত ১৪ জুলাই সপরিবার বিদেশ সফরে গেছেন। এই সময়ে তার বিদেশ ভ্রমণ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দক্ষিণ সিটির আওতাধীন পূর্ব জুরাইন এলাকার বাসিন্দারা মশকনিধন কার্যক্রমে গাফিলতির অভিযোগ এনে সমাবেশও করেছেন। নাগরিকরা মনে করেন, মশকনিধন কার্যক্রমে সামনে থেকে মেয়রদের নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তাহলে কাজটা ঠিকভাবে হতো।

দক্ষিণের মেয়র ১৪ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ১৭ দিন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যুক্তরাজ্য, স্পেন, ডেনমার্ক ও সেনজেনভুক্ত অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করবেন। যদিও এই ভ্রমণের বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়া এবং যাবতীয় ব্যয়ভার মেয়র ব্যক্তিগতভাবে বহন করবেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে ভ্রমণের ব্যয় বহন করা হবে না। কিন্তু এটাই কি ডেঙ্গু আক্রান্ত নাগরিকদের জন্য নগরপিতার দায়িত্বপালনের শেষ কথা?

মন্ত্রী মহোদয় ও মেয়র সাহেব অবশ্যই পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে বেড়াতে যেতে পারেন। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার সময়টা চিন্তা করা উচিত ছিল। দেশের মানুষ যখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় প্রমাদ গুনছেন, তখন যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মেয়র সেটা অনুভব না করেন এবং বেড়ানোর জন্য বিদেশে পাড়ি জমান, তাহলে তা জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক বৈকি। সেই সঙ্গে বলতে হয় এটা বেশ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।

মেয়রের বিদেশযাত্রার পরের দিন 'মশকনিধনে গাফিলতির প্রতিবাদে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে' সমাবেশ করেছেন পূর্ব জুরাইন এলাকার বাসিন্দারা। সমাবেশে অভিযোগ করা হয়, সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতার কারণে ডেঙ্গু আজকে মহামারির আকার ধারণ করেছে। শুধু জুরাইনবাসী নয়, ঢাকা শহরবাসীদের প্রায় সবারই এখন এই অভিযোগ।

ডেঙ্গু আরও কতদিন থাকবে, আরও কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন, কতজন অসুস্থ হয়ে ভুগবেন, কত বাবা-মায়ের বুক খালি হবে, কত পরিবার দুর্দশার মধ্যে পড়বে, তা এখনই বলা সম্ভব না হলেও আমরা অন্তত এটা বুঝতে পারছি, দেশে সাধারণ মানুষকে রোগে-শোকে সহায়তা ও আশ্রয় দেওয়ার মতো কোনো অভিভাবক নেই। নেই রোগ ঠেকানোর কোনো চেষ্টাও।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগ কর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
FY2026 Budget,

How the FY2026 budget can make a difference amid challenges

The FY2026 budget must be more than a mere fiscal statement.

20h ago