পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ডেঙ্গু

সারা বাড়ি জুড়ে মাকে খুঁজে ফিরছে ছোট্ট নিশান। কোথাও পাচ্ছে না। মাকে না পেয়ে তার কান্না থামছেই না।
নিশানের বাবা স্বপন মিয়া দুই বছর বয়সী নিশানকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিশানের চোখ সবসময় খুঁজে বেড়ায় মাকে।
মাত্র ছয় দিন আগে মাকে হারিয়েছে নিশান। তার মা শারমিন আক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকার একটি পোশাক কারখানার মেকানিক ৩৪ বছর বয়সী স্বপন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতে সবচেয়ে কঠিন সময় কাটাই। নিশান অস্থির হয়ে ওঠে।'
স্বপন তাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকেন; হাঁটুর ওপর বালিশ বিছিয়ে সেখানে নিশানকে শুইয়ে ধীরে ধীরে দোলাতে দোলাতে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
'কিন্তু সে ঘুম থেকে জেগে উঠে মায়ের দুধের জন্য কাঁদে। প্রচণ্ড কাঁদে। বড় ছেলেটা বুঝতে পারে যে তার মা আর নেই। কিন্তু এই ছোট্ট শিশুকে কীভাবে বুঝাব?', বলেন স্বপন।
২৪ বছর বয়সী গৃহিণী শারমিন মারা যাওয়ার আগে প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগেছেন। জ্বরের শুরুতে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্যারাসিটামল খান। কিন্তু মৃত্যুর তিনদিন আগে হঠাৎ বমি করতে শুরু করেন এবং এত দুর্বল হয়ে পড়েন যে আর চলাফেরাও করতে পারছিলেন না।
১৯ সেপ্টেম্বর স্বপন তাকে স্থানীয় স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যান এবং পরীক্ষা করে ডেঙ্গু পজিটিভ পান। ডাক্তারের পরামর্শে সেই রাতেই শারমিনকে ভর্তি করা হয় গাজীপুর সদর হাসপাতালে। কিন্তু শারমিনের শারীরিক অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
ডাক্তার পরামর্শ দেন শারমিনকে ঢাকায় নিতে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) পরিচালিত হাসপাতালে পৌঁছান তারা। ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করেন।
পরদিন সকালে মারা যান শারমিন।
স্বপন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'ওকে যদি আগে এই হাসপাতালে নিয়ে আসতাম, তাহলে হয়তো আজ বেঁচে থাকতো।'
স্বপনের মতো শত শত পরিবার স্বজন হারিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ডেঙ্গুতে তাদের জীবন ও পরিবার বিপর্যস্ত। একটি মশাবাহিত রোগ প্রায় প্রতিদিন দেশের মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, পরিবারগুলোর স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে। সরকারের উদ্যোগে ঘাটতি ও জনসচেতনতার অভাব এই সংকট আরও বাড়িয়েছে।
প্রতি বছর কয়েক শত মানুষ ডেঙ্গুতে প্রাণ হারায়। হাজারো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক কষ্ট ভোগ করেন এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সরকারের মশক নিয়ন্ত্রণ অভিযান কার্যকর হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য পুরনো কৌশল, দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বিত নীতির অভাবকে দায়ী করছেন।
এ বছর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৮৮ জন মানুষ মারা গেছে এবং ৪৪ হাজার ৬৯৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অনেক রোগী ও তাদের পরিবার ডেঙ্গুর তীব্রতা সম্পর্কে সচেতন নয়। গুরুতর অবস্থা হওয়ার পরই কেবল তারা চিকিৎসা নিতে আসে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য দেখায়, এ বছর মারা যাওয়া ডেঙ্গু রোগীর ৮১ শতাংশ তিনদিন বা তার বেশি জ্বর থাকার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ১১৪টি মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, তাদের ৭৪ শতাংশই ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে এবং অর্ধেকই ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের কারণে। তাদের মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গুর পাশাপাশি অন্য রোগেও আক্রান্ত ছিলেন।
আরও উদ্বেগজনক হলো, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অংশের বয়স ২০–৩০ বছর—যারা দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এমনই একজন ছিলেন হাসান বয়াতি। ২৫ বছর বয়সী হাসান ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তিনি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
ছয় দিন জ্বরে ভোগার পর ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে হাসানকে পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয় তার পরিবার। ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারেন তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত। ওই রাতেই হাসান মারা যান।
মাত্র এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন হাসান। তার ভাবী বলেন, 'ওদের সংসার জীবন ঠিকভাবে শুরু হওয়ার আগেই সবশেষ হয়ে গেল। ওর নতুন বৌটাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবো।'
বিধবা চাঁদনী আস্তে করে কেবল বলছিলেন, 'আমার কি হবে?'
সাফিয়া বেগমের গল্পও এমনই। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকার ৪০ বছর বয়সী এই গৃহিণী প্রায় চারদিন জ্বরে ভুগছিলেন। ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর কমে গেলেও থেকে যায় দুর্বলতা। ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের কারণে এমন হচ্ছে মনে করে তিনি আর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেননি।
শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে পরলে ঢাকায় পরীক্ষা করে ডেঙ্গু পজিটিভ জানতে পারেন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পর দিন মারা যান।
সাফিয়ার মেয়ের জামাই মনির হোসেন বলেন, 'আমরা তো জানিই না যে মায়ের ডেঙ্গু হইছে। সাধারণ জ্বর মনে করছিলাম।'
Comments