তীব্র নিন্দার বিবৃতিই সার

গত ১৩ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ১৩টি ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। অর্থাৎ মাসে অন্তত একটি করে।
যেসব ঘটনায় সরকার নিন্দা জানিয়েছে, সেই তালিকা বেশি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। সর্বশেষ নিন্দা জানিয়েছে রাজবাড়ীতে নুরুল হকের মরদেহ কবর থেকে তুলে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায়।
এর আগে নিন্দা জানানো হয়েছিল গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরের ওপর হামলা, এনসিপি নেতাদের ওপর হামলা, সুফি দরগায় হামলা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিবারই তাদের জোরালো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং বিবৃতির শুরু করেছে এইভাবে—'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার … ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়।'
প্রথম প্রথম এসব বিবৃতিতে মানুষ আশ্বস্ত হতো। ভাবতো, অন্তত সরকার কিছু বলছে, চুপ করে বসে নেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বিবৃতিতে দেওয়া আশ্বাস অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
কেন? কারণ, এই নিন্দা জানানোর পর কি কিছু বদলেছে? ভুক্তভোগীরা কি ন্যায়বিচার পেয়েছে? অপরাধীরা কি শাস্তি পেয়েছে? সহিংসতা কি থেমেছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে 'না'।
'নিন্দা' যদি 'জানানো'র মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে সেটা তো কেবল আতশবাজির মতো—যার শব্দ আছে, এক ঝলক আলোর স্ফুরণ আছে, কিন্তু সেই আলো কোনো কাজে আসে না।
'নিন্দা জানানো' কোনো অর্থহীন কাজ না। এটি হতে পারে প্রথম ধাপ, রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান প্রকাশের উপায়। কিন্তু সেখানেই যদি থেমে যাওয়া হয়, কথার ফুলঝুরিই যদি একমাত্র প্রকাশ পায়, কোনো বাস্তব ব্যবস্থা না নেওয়া হয়—তাহলে সেটাকে ফাঁপাবুলি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
বিশ্বজুড়ে এমন নিন্দা জানানোর পর সেই ঘটনায় বিতর্ক হয়, তদন্ত হয়, দৃশ্যমান ব্যবস্থা দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নিন্দাই যেন শেষ ধাপ। এরপর গল্পের অবসান হয়ে যায়। অপরাধ ঘটে, বিবৃতি আসে, তারপর নীরবতা।
ফলাফল? মানুষ বিশ্বাস হারায় এবং এর ফলে তিনটি সমস্যা তৈরি হয়।
প্রথমত, মানুষ আর এমন নিন্দা জানানোতে বিশ্বাস রাখতে পারে না। নাগরিকরা শুধু কথা শোনে, কিন্তু কাজ দেখে না। অপরাধীরাও সেটাই করে এবং এর সুযোগ নেয়।
দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগীরা অসহায় বোধ করে। একবার ভাবুন, আপনি আপনার পরিবার বা ঘর হারালেন, আর আপনার জন্য সরকারের তরফ থেকে এলো সেই বাণী—'আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই...।'
তৃতীয়ত, বিশ্ব বিশ্বাস হারায়। অন্য দেশগুলো প্রশ্ন করতে শুরু করে, বাংলাদেশ কি সত্যিই ন্যায়বিচার নিয়ে আন্তরিক?
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শক্তি ছিল দেশের মানুষের বিশ্বাস। তাদের কাজ—শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নাগরিকদের রক্ষা করা এবং নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু, দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল নিন্দা জানিয়ে যাওয়ায় সেই বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখেছিল। তারা ভেবেছিল, অন্যায় হলে শুধু কথায় নয়, দ্রুত প্রতিকার করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, সেই পুরনো গল্পই বারবার ফিরে আসছে।
শাসন কেবল নীতি প্রণয়ন করা নয়, আস্থা গড়ে তোলার ব্যাপার। মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে, সরকার তাদের রক্ষা করবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং তাদের মর্যাদা রক্ষা করবে।
অথচ, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিবার নিন্দা জানানোর পরের যে অংশ, তাতে শুধু বিশ্বাসের ক্ষয় হচ্ছে। বাংলাদেশিরা 'নিন্দা'র বাণী শুনতে শুনতে ক্লান্ত। তারা ফলাফল চায়, অপরাধীদের শাস্তি চায়, ভুক্তভোগীদের জন্য সহায়তা চায়। দেশের মানুষ কাজ চায়, কেবল বাণী আর বিবৃতি নয়।
যতক্ষণ পর্যন্ত দৃশ্যমান কাজ হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি 'দৃঢ় নিন্দা' জ্ঞাপন সরকার শক্তি নয়, শব্দে মোড়ানো দুর্বলতা প্রকাশ করে যাবে।
Comments