চাকরির বাজার: তরুণদের অবস্থান কোথায়?

অলঙ্করণ: স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

দেশে গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠিত হয়েছে—যার শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে। যুবদের শোভন কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনা বেশকিছু যাবৎ আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে আলোচ্য বিষয়। বিভিন্ন ধরনের তথ্য-প্রমাণ বলে দেয়, বাংলাদেশে যুবদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কতটা সংকুচিত ও সংকটপূর্ণও বটে।

কর্মসংস্থানের অভাব তো আছেই, অন্যদিকে শোভন কর্মক্ষেত্রের অভাবে এই যুবদের বেশিরভাগকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়—যা সামগ্রিকভাবে শুধু যুবদের কর্মদক্ষতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, একইসঙ্গে ধীরে ধীরে তাদের কর্মস্পৃহা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত যুব জনমিতির প্রত্যাশিত সুফল ব্যর্থতায় পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ। (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২২)

দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি বিশাল এই যুব জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে, যদি তারা সঠিক ক্যারিয়ার গাইডেন্স, উদ্ভাবনী উদ্যোগ, দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের চাকরির বাজারে তাদের অবস্থান কোথায়?

প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ লক্ষাধিক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাদের বেশিরভাগেরই বাজার-উপযোগী দক্ষতা না থাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমবাজারের সংযোগহীনতা এর প্রধানতম কারণ।

এর ফলে, বিগত কয়েক বছরে বেড়েই চলেছে বেকারত্ব, যুব বেকারত্ব ও অপ্রতুল কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (শ্রমশক্তি জরিপ, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ এবং যুব বেকারত্বের (১৫–২৯ বছর) হার ৭.২ শতাংশ—যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ৯৪ লাখ তরুণ বেকার রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি, আবার শহরে পুরুষের তুলনায় নারী যুব বেকারের হার বেশি।

বিগত কয়েক বছরে উদ্বেগজনকভাবে অপ্রতুল কর্মসংস্থান ও নিট (এনইইটি—নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) জনগোষ্ঠীর হারও বেড়েছে। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ অপ্রতুল কর্মসংস্থানে রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশির বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। পাশাপাশি ৩০.৯ শতাংশ তরুণ বর্তমানে নিট-এর মধ্যে রয়েছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। অর্থাৎ আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা শ্রম বাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না।

শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৯ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে।

২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, স্নাতক বা তারচেয়ে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণকারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ এবং সে সময়ে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ লাখ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা তরুণদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভূক্ত ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও মাত্র ২১ শতাংশ চাকরি পায় এবং ৬৬ শতাংশ ৩ বছর পর্যন্ত বেকার থাকে।

আবার পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেকারত্বের হার বেশি এবং বেকারদের মধ্যে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার সঙ্গে শ্রম বাজারের একটি বড় ধরনের দক্ষতাগত পার্থক্য রয়েছে।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরেও আমাদের অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত নয়। এমনকি বিভিন্ন সফট স্কিলসের (উদাহরণস্বরূপ: কমিউনিকেশন দক্ষতা, নেতৃত্ব দক্ষতা, ভাষা দক্ষতা) ক্ষেত্রেও তাদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

সুতরাং এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, কেবল উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটই চাকরির বাজারের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং প্রয়োজন শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন ও খাতভিত্তিক প্রস্তুতি।

বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থান ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তির প্রসার, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোভিড-১৯ ও বিশ্বায়নের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী চাকরির ধরন ও চাহিদায় এসেছে বড় পরিবর্তন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই পরিবর্তনের প্রভাব আরও গভীর, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ওপর।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের 'ফিউচার অব জবস' প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিভিন্ন ডিজিটাল দক্ষতায় বিশ্বব্যাপী মোট ১৭ কোটি নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এআই, মেশিন লার্নিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো ক্ষেত্রে তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

অপরদিকে, বিদ্যমান পেশায় বিশ্বব্যাপী ৯ কোটি ২০ লাখ চাকরি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পুনরাবৃত্তিমূলক, ম্যানুয়াল (হাতের কাজ) ও দাপ্তরিক পেশা—যেমন: ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, হিসাবরক্ষক সহকারী, অ্যাডমিন অ্যাসিস্ট্যান্ট ও টেলিমার্কেটার।

সম্প্রতি চাকরিদাতা প্লাটফর্ম 'সম্ভব জবস' কর্তৃক বাংলাদেশে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, সোলার টেকনিশিয়ান, ট্যুর গাইড, ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ, কাস্টমার সাপোর্ট, কনটেন্ট নির্মাতা, ডিজিটাল মার্কেটার, রিমোট কাজ, ফ্রিল্যান্সার, ডেটা অ্যানালিস্ট ইত্যাদি পেশায় তরুণদের কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

লাইনক্যাসেল পার্টনার্স কর্তৃক ২০২৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, রিটেইল, ব্যাংকিং, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট ও বায়োটেক খাতে ২০২৮ সালের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।

সরকারের নতুন চর্চা অনুযায়ী, সরকার ত্রৈমাসিক ভিত্তিকে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করে থাকে। যার সর্বশেষটি ২০২৪ সালের আক্টোবর-ডিসেম্বরের চিত্র বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট এ প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকারত্ব হার আগের থেকে বেড়েছে।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বাজারে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় যুবদের শোভন কর্মসংস্থানের সংস্থান কোনো কোনো ক্ষেত্র আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়েছে।

তবে এই সংকট একদিনে মোকাবিলা করা যাবে না। এ থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

স্বল্পমেয়াদী কর্মসূচির মধ্যে যুবদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার, একটি তালিকার ভিত্তিতে। যারা কর্মসংস্থান হারিয়েছে তাদের সহযোগিতা করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পরে। অন্যদিকে নারীদের কর্মসংস্থানের সুরক্ষা ও উন্নয়ন টেকসই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয়।

মধ্যমেয়াদী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিল্পখাতের সংযোগ বাড়াতে হবে। কারিকুলাম তৈরি, প্রশিক্ষণসহ প্রতিটি ধাপে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টার্নশিপ বা এ্যাপ্রেনটিচশীপ প্রোগ্রামের ওপর জোর দিতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থী বা প্রশিক্ষণার্থীরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় এবং এর প্রতিফলন থাকতে হবে শিল্পনীতিতে। অন্যদিকে বেকার যুবদের একটি তালিকা প্রণয়ন তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতে পারে।

সর্বশেষে, দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব নীতি—যেমন: শিক্ষা নীতি, দক্ষতা উন্নয়ন নীতি, শিল্প নীতির শুধু আধুনিকায়ন করলেই হবে না, এসব নীতির বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। তাহলে বাংলাদেশ যুব জনমিতির সুফল ঘরে তুলতে পারবে।


নাজমুল আহসান, উন্নয়নকর্মী; [email protected]

এইচ. এম. আসাদ-উজ-জামান, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ; [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Airport fire exposes costly state negligence

The blaze that gutted the uninsured cargo complex of Dhaka airport on Saturday has laid bare a deep and dangerous negligence in risk management across government installations.

5h ago