প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস বিকৃতির কূটচাল
প্রতিবছর আমরা বিজয় দিবস উদযাপন করি। তবু মনের এক কোণে জমে থাকে বেদনার মেঘ—ঠিক দুদিন আগেই আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের সূর্য সন্তানদের। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর কখনো ফিরে আসেননি তারা।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমরা যখন বাংলাদেশের বিজয় উদযাপন করছি, তখনো একটা গোষ্ঠী তাদের অতীত কৃতকর্ম ঢাকতে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোকে যেন ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় একের পর এক মিথ্যা বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করে তাদের মিথ্যা প্রতিষ্ঠার এ চেষ্টা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চব্বিশের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতা তাদের দলের ঐতিহাসিক অবস্থান পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। যেন এসব মিথ্যা বয়ান তাদের আরও গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তুলবে। এই ১৪ ডিসেম্বর আমরা যখন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছি, সেদিন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ভারত চক্রান্ত করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল ১৯৭১ সালে। তার দাবি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ।
চট্টগ্রাম জামায়াতের আমিরও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তার দাবি, ১৯৭১ সালে অন্য কেউ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। সন্দেহের তীর স্বভাবতই ভারতের দিকে যায়।
এসব নতুন নতুন বয়ানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি জনগণের ওপর নয় মাস ধরে চলা হত্যাযজ্ঞ থেকে পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের দায়মুক্তি দেওয়ার একটা অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এসব উদ্ভট ও অযৌক্তিক বক্তব্য সামান্য তলিয়ে দেখলেই মিথ্যাচার ধরা পড়ে যায়।
এমন ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত দাবি কোনোভাবেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিংবা তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদরদের গণহত্যার দায় থেকে মুক্তি দেবে না। অসংখ্য সাক্ষীদের কথা আমরা শুনেছি, যারা বলেছেন কীভাবে আল-বদর বাহিনী (জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত) বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে।
২০১৩ সালে সুমন জাহিদ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তার মা সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিন তার মামাও দেখেছিলেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যেতে।
দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সালের ২২ জুলাই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন সুমন জাহিদ। খবরের কাগজে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের ছবি দেখে চিনতে পারেন তার মামা। সুমনের মামা বলেছিলেন, সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যেতে যারা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন।
সেলিনা পারভীন সম্পাদিত শিলালিপিতে লিখতেন মুক্তিকামী বাঙালি। এ কারণে তাকে টার্গেট করে আল-বদর বাহিনী। সুমন জাহিদ সাক্ষ্য দেন, তিনি ছাদ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন দুপুর দেড়টার দিকে হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস, একটা জিপগাড়ি ও সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি এসে থামে নিউ সার্কুলার রোডে তাদের বাসার সামনে। সেসময় সেলিনা পারভীন রান্না করছিলেন। গাড়িগুলো থেকে অচেনা-অপরিচিত বন্দুকধারীরা নেমে এসে সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যায়।
যাওয়ার আগে তিনি সুমনের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, মামার সঙ্গে খেয়ে নিতে এবং তিনি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসবেন। কিন্তু সেলিনা পারভীন আর ফেরেননি।
এ ধরনের সাক্ষ্য অনেক পাওয়া যায়। এর জন্য নথিপত্র ঘাঁটার প্রয়োজন পড়ে না। দ্য ডেইলি স্টারের আর্কাইভেও এ ধরনের অনেক সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর নুসরাত রাব্বির বক্তব্যে তার বাবা ডা. ফজলে রাব্বিকে তুলে নেওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। তার মা তাকে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে মিথ্যা বলে ফজলে রাব্বিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা বলেছিল, ক্যান্টনমেন্টে খুবই অসুস্থ রোগী রয়েছে, তাকে দেখতে যেতে হবে। ফজলে রাব্বি তখন বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক। কিন্তু সেই শেষ যাওয়া, আর ফিরে আসেননি তিনি।
চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের তৎকালীন ডিন বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার উল্লেখ করেছেন শওকত হোসেন। তিনি বলেছেন, মুনীর চৌধুরীর ছোট বোন রাহেলা যতদূর মনে করতে পারেন, সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টা। একটি জিপ এসে দাঁড়ায়। গাড়িতে যারা ছিলেন, তাদের মুখ ঢাকা ছিল। দরজায় কড়া নেড়ে তারা মুনীর চৌধুরীর খোঁজ করেন। আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের মুনীর চৌধুরীর ছাত্র দাবি করে কথা বলতে চেয়েছিল। সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসেননি মুনীর চৌধুরী।
এসব অপহরণ বা তুলে নিয়ে যাওয়ার তথ্য বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য বা স্মৃতিচারণে আমরা পাই। এতে একটা সাধারণ চিত্র দেখা যায়, এগুলো ছিল একই ছকের। অর্থাৎ একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দুদিন পর মানুষ জানতে পারে, তাদের সবাইকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'ঢাকার বাইরে একটি মাঠে আজ অন্তত ১২৫ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার শিকার ব্যক্তিরা চিকিৎসক, অধ্যাপক, লেখক ও শিক্ষক।'
১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়, তাদের হাত পেছনে বাঁধা ছিল। তাদের প্রত্যেককে হয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে কিংবা গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে অথবা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আনুমানিক ৩০০ বাঙালি বুদ্ধিজীবিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
ঢাকা থেকে পাঠানো প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'ধারণা করা যায়, (পাকিস্তানপন্থী) রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণের শর্ত আদায়ে তাদের "জিম্মি" করে রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানি কমান্ডারদের আত্মসমর্পণের দুদিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।'
এতে আরও বলা হয়, এমনকি আত্মসমর্পণের দুদিন পরেও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এবং রায়েরবাজার ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল। রাজাকাররা একটি কারখানায় অবস্থান নিয়েছিল, যেখানে তাদের সঙ্গে ভারতীয় টহল দলের বন্দুকযুদ্ধ হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, নিখোঁজদের খুঁজে পাওয়ার আশায় তাদের স্বজনেরা সেখানে গেলে রাজাকাররা তাদের ওপরও গুলি চালায়।
জামায়াতের পত্রিকা 'সংগ্রাম'-এ প্রকাশিত সংবাদই প্রমাণ করে যে, দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জামায়াত এবং এর ছাত্র সংগঠন পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার জন্য রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদি বাহিনী গড়ে তুলেছিল।
এই বাহিনীগুলো স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও পরিবারগুলোকে চিনিয়ে দিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করতো। তারা খুন ও ধর্ষণে সহায়তা করেছে, জ্বালাও-পোড়াও ও লুটতরাজেও সম্পৃক্ত ছিল। কথিত 'শান্তি কমিটি' গঠনেও জামায়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার সঙ্গে তাদের সহযোগিতাকে আড়াল করতে একটি বেসামরিক মুখোশ হিসেবে সারা বাংলাদেশে শান্তি কমিটির শাখা গঠন করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা হিসেবে মতিউর রহমান নিজামী (পরবর্তীতে জামায়াত প্রধান হয়েছিল) আল-বদর বাহিনীর প্রধানও ছিলেন, যারা আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল। জামায়াত গুরু গোলাম আযম স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ভূমিকার জন্য দায়ী ছিলেন।
রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও একই রকম গোষ্ঠীগুলো ১৯৭১ সালে তাদের নৃশংস ভূমিকার জন্য চিরকাল ঘৃণাভরে মানুষের মনে থাকবে। আর পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশিদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার দায় থেকেও তারা কখনো মুক্তি পাবে না।
যারা ইতিহাস বিকৃতি করতে চায়, তাদের এসব অপচেষ্টা আমাদের স্মৃতির ওপর সরাসরি আঘাত। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এই অবমাননায় যদি আমরা নীরব থাকি, তবে আমরাও বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগীতে পরিণত হবো। তাই এখন প্রয়োজন আরও বেশি করে ইতিহাস পাঠ ও পুনরালোচনা করা, এতে আমাদের শেকড়টাও শক্ত হবে।


Comments