হারিয়ে যাওয়া গর্জনের প্রতিধ্বনি

মিরপুরের বিকেলটা আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। আকাশে সূর্যের আলো ঝিমিয়ে পড়েছে, হালকা কুয়াশা ফ্লাডলাইটের আলোয় ভেসে বেড়াচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ, তবু গ্যালারির চেহারা যেন এক ভুলে যাওয়া যুগের প্রতিচ্ছবি। বিস্তীর্ণ সিটের সারি ফাঁকা, যেন কেউ আর ফিরে আসবে না। এই মাঠ, যেখানে একসময় প্রতিটি উইকেটে, প্রতিটি রানেই গর্জে উঠত হাজারো কণ্ঠ, আজ সেখানে বাতাসের শব্দই সবচেয়ে স্পষ্ট।

স্টেডিয়ামের বাইরে সেই পুরোনো দৃশ্যেরও আর কোনো রঙ নেই। পতাকা বিক্রেতারা এখন বসে আছে ধুলো মাখা ফুটপাথে, হাঁটু জড়িয়ে। তাদের হাতে লাল-সবুজ পতাকা, কিন্তু সেই রঙেও যেন মলিনতা লেগে আছে। একসময় ম্যাচের দিন মানেই ছিল উৎসব। সকাল থেকেই তারা দাঁড়াত টিকিট কাউন্টারের সামনে, মুখে হাসি, হাতে স্বপ্ন। আজ সারাদিন বসে থেকেও বিক্রি হয়নি তেমন কিছু। দেলোয়ার, যিনি গত ১২ বছর ধরে এখানে পতাকা বিক্রি করেন, মৃদু হেসে বললেন, 'ভাই, একসময় দুপুরের আগেই সব বিক্রি হয়ে যেত। আজ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, হাতে আছে গোটা ত্রিশটা। মানুষ আসে না, আসে না সেই উৎসাহও। পতাকা নেড়ে কী হবে, যখন মাঠে জেতার বিশ্বাসই নেই।'

তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, আছে কেবল এক ধরনের শূন্যতা, যেন পতাকার কাপড়ের ভাঁজে আটকে আছে হারিয়ে যাওয়া উল্লাসের প্রতিধ্বনি। পাশেই এক যুবক কালোবাজারি, মুখে অসহায়ের হাসি, ৩০০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকায় বিক্রি করতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ নিল না। শেষমেশ অনুনয় করেই বলছিল, 'ভাই, সাড়ে তিনশত দিলেও নেন, সারাদিন কষ্ট করছি পঞ্চাশটা টাকা আমার থাকে।' তবুও কেউ থামল না। তার কণ্ঠে হতাশা নয়, বরং অবিশ্বাস। যেন বুঝতে পারছে না, এ কি সত্যিই সেই বাংলাদেশ, যেখানে ক্রিকেট একসময় ছিল ধর্মের মতো পবিত্র?

এই গ্যালারিই একসময় ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের হৃদস্পন্দন। ২০০০ সালে যখন আইসিসি বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা দেয়, তখন তারা বলেছিল, এই দেশের দর্শকদের ভালোবাসাই নাকি তাদের প্রেরণা। সেই দর্শকরাই আজ দূরে সরে গেছে, ধীরে ধীরে। একসময়কার বাঁশি, ড্রাম, পতাকার নাচন আজ যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে সময়ের ভিড়ে। মাঠের বাইরেও যেন সেই আবহ নেই, চায়ের দোকানে নেই সেই উত্তেজিত বিতর্ক, রিকশাচালকও আর ক্রিকেট নিয়ে তর্কে মেতে ওঠে না।

ঢাকার কর্পোরেট অফিসে কাজ করেন জুবায়ের রশিদ। তিনি বললেন, 'এক বন্ধু স্পন্সর কোম্পানিতে কাজ করে, ফ্রি টিকিট দিয়েছিল। ভাবলাম কয়েকজন পুরোনো ক্রিকেটপ্রেমী বন্ধুকে নিয়ে মাঠে যাব। ফোন করলাম সবাইকে, কেউ রাজি হলো না। বলল, "ভাই, গিয়ে কী হবে, হার দেখতে?" তখনই বুঝলাম, ক্রিকেট এখন আর উৎসব নয়, অভ্যাসটাও হারিয়ে গেছে।'

তার চোখে একরাশ ম্লান আলো, যেন পুরোনো ভালোবাসার শেষ প্রদীপটাও নিভে যাচ্ছে।

মাঠের ভেতরে দৃশ্যটা যেন সেই হতাশারই প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ দলে এখন আর আগের মতো জৌলুস নেই। ব্যাটসম্যানদের প্রতিটি রান আসে প্রচণ্ড সংগ্রামের পর, যেন পাহাড় ঠেলে এগোনো। বোলারদের শরীরে সেই আগুন দেখা যায় না। দর্শকরা একেকটা বলের সঙ্গে তাল মেলাতে চায়, কিন্তু পারছে না। কারণ উত্তেজনা আর বিশ্বাস, দুটোই হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাম্প্রতিক ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার দুঃখ এখনো কাটেনি সমর্থকদের। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে, ওয়ানডে ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রিয় সংস্করণ। যে দল একসময় ভারতের মতো পরাশক্তিকে হারিয়েছিল, যারা ২০১৫ সালে ছিল গর্বের প্রতীক, সেই দল আজ আফগানিস্তানের বিপক্ষেও দাঁড়াতে পারে না। একসময়কার তারকা দল এখন তারকা শূন্যতায় ভুগছে। তামিম নেই, সাকিবের আলো নিভে এসেছে, মুশফিকের দৃঢ়তা ম্লান, নতুন মুখেরা মাঠে নামছে, কিন্তু তারা এখনো কাঁধে নিতে পারেনি সেই ভার, যা একসময় এক প্রজন্ম বহন করেছিল গর্বের সঙ্গে। এক দর্শক নীরবে বললেন, 'দলটা এখন যেন রাতের আকাশ, যেখানে একটার পর একটা তারা নিভে গেছে, কেবল অন্ধকারটাই বাকি।'

ধানমণ্ডি থেকে আসা সাইফুল যেন এই নিস্তব্ধতার মধ্যে এক ব্যতিক্রম। স্ত্রীকে নিয়ে স্টেডিয়ামে বসে হাসতে হাসতে বললেন, 'মূলত স্ত্রীকে নিয়েই এলাম। ভাবছিলাম আজ মিরপুরে না এসে দিয়া বাড়িতে ঘুরে যাই, কিন্তু শেষমেশ ভাবলাম, যাই ক্রিকেট দেখি। মায়ের দোয়া টিমের খেলা দেখতে এলাম (হাসি)। আগে যখন কেউ আউট হতো সবাই চুপ হয়ে যেত, আজ দেখছি উল্টো হাসাহাসি!' তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, 'যা-ই হোক, ওরা সবসময়ই বিনোদন দেয়। এইতো আফগানিস্তানের বিপক্ষেও কি বিনোদনটা দিল।' বলেই আবার সেই হাসি।

তার পাশে বসা ইয়তার স্ত্রী মুসলিমা হাসিমুখে বললেন, 'আমি তেমন ক্রিকেট বুঝি না। ও অনেক পছন্দ করে, তাই এসেছি। খেলা কেমন বুঝি না, কিন্তু মাঠের বাতাসে একটা আনন্দ আছে, সেটা অনুভব করতে পারি।'

মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র নাসিফ এসেছে বাবার সঙ্গে। তার চোখে কোনো ব্যর্থতার ছায়া নেই, আছে কেবল সহজ উত্তেজনা। 'বাংলাদেশ খেলছে, তাই এসেছি। খেলা মোটামুটি লাগছে,' বলল সে সরলভাবে। পাশে বসা তার বাবা শফিক হেসে বললেন, 'আসলে আমরা এসেছি দেশের টানেই। আমরা না আসলে তারা উৎসাহ পাবে কীভাবে? মাঝেমধ্যে খেলা দেখতে ভালো লাগে। হ্যাঁ, এই টাকায় অন্য কিছু করা যেত, কিন্তু এই অনুভূতি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।'

তবু মাঠের ভেতরের দৃশ্য যেন বাইরের নীরবতারই প্রতিফলন। ব্যাটিং করতে নেমে টাইগাররা যেন এক অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। আফগানিস্তানের বোলারদের বিপক্ষে রান তোলা যেন পাহাড়ে পাথর গড়ানোর মতো কষ্টকর। দর্শকের মুখে হতাশার ছায়া। কেউ চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে আছে, কেউ কপালে হাত রেখে বলে উঠছে, 'ক্রিকেটের এমন দিন দেখব ভাবিনি।'

কেউ কেউ হয়তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, এই সেই বাংলাদেশ দল যারা ২০১৫ সালে বিশ্বকাপে একের পর এক জয় এনে জাতিকে একত্র করেছিল। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের দল তখন ছিল স্বপ্নের নাম, গর্বের প্রতীক। আজ সেই দলই তারকা-শূন্যতায় ভুগছে। নতুনদের মধ্যে কেউ কেউ চেষ্টা করছে, কিন্তু সেই আগুনে আবেগটা যেন আর নেই। গ্যালারির ফাঁকা সিটগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, ভালোবাসা এখনো আছে, কিন্তু বিশ্বাসটা কোথাও হারিয়ে গেছে।

ফ্লাডলাইটের আলো জ্বলে উঠল সন্ধ্যা ঘনাতেই। মাঠের ঘাসে তার সাদা আলো পড়লে মনে হলো যেন ক্রিকেটের পুরনো জৌলুস ফিরে আসার চেষ্টা করছে। কিছু দর্শক তখনো কিছু ঢুকছে—হয়তো বাসা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শেষ বিকেলের খেলাটা দেখা যাক। কিন্তু সেই সামান্য বৃদ্ধি আড়াল করতে পারেনি হাজারো শূন্য আসনের নিস্তব্ধতা।

গ্যালারির নীচে এক বিক্রেতা শেষ চেষ্টায় চা বিক্রি করছে। মুখে বলল, 'খেলা খারাপ গেলে চা বিক্রিও কমে যায়, ভাই।' পাশে তারই ছোট ভাইটা চুপচাপ বসে পতাকা নিয়ে খেলছে। সেই পতাকাই হয়তো একদিন আবার উড়বে, নতুন কোনো জয়ের দিনে।

আজকের এই নিস্তব্ধতা হয়তো সময়ের দাবি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গ থেকে পতনের সময়টুকু পার করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। কিন্তু এই নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগুনের ছাই, যেখান থেকে আবার জ্বলে উঠতে পারে নতুন বিশ্বাস, নতুন আশার শিখা।

ফ্লাডলাইটের নিচে দুলতে থাকা পতাকাটা তখনও হালকা বাতাসে নাচছে, মৃদু, কিন্তু অটল। যেন বলছে, 'সব শেষ হয়নি। কেবল এক নতুন ভোরের অপেক্ষা।'

Comments

The Daily Star  | English

Crime reporters form human chain, condemn attacks on Prothom Alo, Daily Star

Journalists demand impartial investigation, calling the violence a direct assault on press freedom

1h ago