সরকারের ৫০ হাজার টন আলু কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল
বাজারদর উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে ৫০ হাজার টন আলু কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রায় এক সপ্তাহ আগে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সরকারের সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আলু কেনার পরিকল্পনা বিস্তারিত আলোচনায় আসে।
তিনি বলেন, 'পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই পর্যায়ে আলু কেনা কৃষকদের তেমন উপকার করবে না; বরং লাভবান হবে কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।'
কর্মকর্তা আরও জানান, আগামী মৌসুমে কৃষকদের সরাসরি লাভবান করতে কী প্রণোদনা দেওয়া যায় সরকার এখন সেটা নিয়ে আলোচনা করছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আলুর বীজ বপনের মৌসুম অক্টোবর–নভেম্বর এবং সংগ্রহকাল ফেব্রুয়ারি–এপ্রিল।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বর্তমানে বাজারে আলুর দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা প্রতি কেজি। 'এ অবস্থায় সরকার যদি আরও কম দামে আলু বিক্রি করে, তাহলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে,' মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এখন আর আগের আলু কেনার পরিকল্পনা কার্যকর থাকবে না। 'এই পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে—তাই সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।'
তিনি আরও জানান, সাধারণত কৃষক ও ব্যবসায়ীরা নভেম্বরের মধ্যে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বের করে থাকেন। তবে ১৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের অনুরোধ করা হয়, যেন ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা আলু সংরক্ষণ করে এবং কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা তাতে সম্মতি দেন।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ডেইলি স্টারকে বলেন, গত আগস্টে কোল্ড স্টোরেজে আলুর দাম ছিল ১২–১৪ টাকা প্রতি কেজি। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে দাম বেড়ে ১৬–২০ টাকা এবং মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে ১৪–১৫ টাকা প্রতি কেজি।
তিনি জানান, বর্তমানে দেশজুড়ে কোল্ড স্টোরেজগুলোতে ১৩.৭৫ লাখ টন আলু মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ৬.৯০ লাখ টন খাবার আলু এবং বাকিগুলো বীজ আলু।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারকে 'কৃষকদের প্রতি অবহেলা' বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, 'সরকার ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু কিছুই কেনা হয়নি। কৃষকরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে, অথচ সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি বড় ধরনের ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা।'
তিনি জানান, বর্তমান বাজারদর উৎপাদন ব্যয়ের নিচে। কোল্ড স্টোরেজসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে দাম হওয়া উচিত প্রতি কেজি ২৫–২৭ টাকা, অথচ সরকার নির্ধারিত ২২ টাকাও মিলছে না।
'সরকার যদি মোট উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশও কিনত, তাহলে বাজারদর বাড়ত ও স্থিতিশীল হতো এবং মজুদকারীরা ধীরে ধীরে আলু ছাড়তে পারত,' বলেন তিনি।
কেন আলু কিনতে চেয়েছে সরকার
বাজারদর কমে কৃষকদের ক্ষতি বাড়ায় চলতি বছরের আগস্টের শেষদিকে ৫০ হাজার টন আলু কেনার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
২৭ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, কেনা আলু কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হবে এবং অক্টোবর–নভেম্বরের মধ্যে বাজারে ছাড়া হবে। কোল্ড স্টোরেজ গেটে ন্যূনতম বিক্রিমূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি ২২ টাকা।
উৎপাদন খরচের নিচে আলুর দাম নেমে যাওয়ায় কৃষকদের উদ্বেগ বাড়লে সরকার চার সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। কৃষি সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে বাণিজ্য, খাদ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কেনার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
গত মৌসুমে অনেক কৃষককে মাঠপর্যায়ে প্রতি কেজি মাত্র ১১ টাকায় আলু বিক্রি করতে হয়—যা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে গড় উৎপাদন ব্যয় ১৪ টাকার চেয়েও কম। উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি কেজি ২০ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে, গত মৌসুমে দেশে ১ কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আবাদি জমি বৃদ্ধি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে।


Comments