প্রাথমিক পেরোনো ৪৪% শিক্ষার্থী পৌঁছাচ্ছে দশম শ্রেণি পর্যন্ত

ছবি: সৌজন্য

বাংলাদেশে ৮৪ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করলেও অর্ধেকেরও কম শিশু মাধ্যমিক শেষ করতে পারে। নতুন এক সরকারি জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেখা গেছে, অনেক শিশু উচ্চ মাধ্যমিকের (নবম ও দশম শ্রেণি) আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়।

গত রোববার প্রকাশিত 'মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে–২০২৫' জানায়, নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েরা, মাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে বেশি। তবে নিম্ন মাধ্যমিকে (৬-৮ শ্রেণি) ছেলেরা বেশি ঝরে পড়ে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যৌথ একটি জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর এক বছরের বেশি সময় ধরে এই জরিপ করা হয়।

জরিপ অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক শেষ করার হার ছেলে শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৭৬ শতাংশ।

মাধ্যমিক শিক্ষাকে এই জরিপে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে—নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। উচ্চ মাধ্যমিক বলতে এখানে নবম ও দশম শ্রেণিকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ হাজার ৯৬৮টি মাধ্যমিক স্কুলে মোট ৮১ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

শিক্ষাবিদদের মতে, অর্থনৈতিক সংকট ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক শেষ করার আগেই স্কুল ছাড়ে।

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (ক্যাম্প) সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'এই অবস্থা উদ্বেগজনক। অন্যান্য গবেষণাতেও একই ধরনের পতনের প্রবণতা দেখা গেছে।'

তার মতে, বাল্যবিয়ে মেয়েদের ঝরেপড়ার বড় কারণ। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুল না চালিয়ে বিয়ে দিতে চায়। আবার দরিদ্র পরিবারগুলোতে ছেলেদের কাজে লাগানোর চাপ বেশি। অনেক পরিবার মনে করে, ছেলে আয়-রোজগার করলে তা পরিবারের কাজে লাগবে।

এ ছাড়া, তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক স্কুলে শেখানোর পদ্ধতি আকর্ষণীয় না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আগ্রহ হারায়। অনেক স্কুল বেসরকারিভাবে পরিচালিত হওয়ায় মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

আরেক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে ও ছেলেদের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে শ্রমবাজারে ঢুকে পড়া—দুই কারণে ঝরেপড়া বাড়ছে। অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যয়কে বাড়তি মনে করে। কারণ মেয়েদের অনেক সময় রিকশায় যেতে হয়, ছেলেরা হেঁটেই যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগেভাগে স্কুল ছাড়ার কারণে দেশ দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক, অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। দুই, যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে তারা ভালো কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ তাদের জন্য উপযুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণের নীতি বা কর্মসূচি নেই।

ধারাবাহিক পতন

জরিপে দেখা গেছে, সব বিভাগেই প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক এবং তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করার হার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ, নিম্ন মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মাত্র ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এর উপরের শ্রেণিগুলোতে উপস্থিতি বাড়ানোকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই জরিপের তথ্য সেই নীতির বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু, তাই দেখিয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, দরিদ্র পরিবারের মাত্র ২১ শতাংশ শিশু নবম—দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে। এটা জাতীয় গড়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ পয়েন্ট কম। তার বিপরীতে সচ্ছল পরিবারের প্রায় ৬৬ শতাংশ শিশু এই পর্যায়ে পৌঁছায়।

এ ছাড়া শহরের ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী দশম শ্রেণি শেষ করতে পারে, গ্রামে এ হার ৪২ শতাংশ।

সিলেটে নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, উভয় স্তরে শিক্ষার্থীদের স্কুল শেষ করার হার সবচেয়ে কম। ঢাকায় প্রাথমিক পাস করে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ, কিন্তু দশম শ্রেণি শেষ করে মাত্র ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হারও একইভাবে কমছে। প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি ৮৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কিন্তু নিম্ন মাধ্যমিকে কমে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশে এবং উচ্চ মাধ্যমিকে মাত্র ৫০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। সিলেটে উচ্চ মাধ্যমিকে উপস্থিতি সবচেয়ে কম—মাত্র ৪৪ শতাংশ।

সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের শিশু এবং ছেলেরা স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকে। আর ধনী পরিবার ও মেয়েরা বেশি স্কুলে যায়। এর পিছনে অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে জরিপে।

করণীয় কী

রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, শিক্ষার্থীদের স্কুলে রাখতে হলে পড়াশোনাকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে। তিনি শিক্ষার মান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা জোর দিয়ে বলেন, শিক্ষাবিদরা বারবার আহ্বান করলেও সরকারি বাজেট ধারাবাহিকভাবে কমছে। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে এটা বাড়ানো জরুরি।

তিনি আরও বলেন, ভালো শিক্ষক প্রস্তুত করতে এবং শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।

Comments