সুইডেন-ফিনল্যান্ডের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে কেন চিন্তিত এরদোয়ান

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, তুরস্ক, ভূমিকম্প, তুরস্কে ভূমিকম্প, জরুরি অবস্থা,
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ন্যাটোর সদস্যপদ চায় সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। তবে, দেশ ২টির সেই স্বপ্নে সবচেয়ে বড় বাধা এখন তুরস্ক। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের এমন সিদ্ধান্তে মোটেও সন্তুষ্ট নন। কিন্তু, কেন এরদোয়ান চান না উত্তর ইউরোপের দেশ ২টি ন্যাটো সদস্য হোক?

এরদোয়ানের দাবি, তুরস্কের কুর্দি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সমর্থন আছে। এ কারণে তিনি দেশ ২টিকে ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দিতে পারবেন না। কারণ, এটি আঙ্কারার জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলবে।

রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরাসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ন্যাটো মহাসচিব জেনারেল জেনস স্টোলটেনবার্গ জানিয়েছেন, ন্যাটো জোট সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে কাজ করবে। কিন্তু, এরদোয়ানের ঘোষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নর্ডিক দেশ ২টির সদস্যপদ লাভের পথ মোটেও মসৃণ হবে না।

তবে, যে কোনো দেশের জন্যই ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে তুরস্কের অনুমোদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সামরিক জোটটি ঐকমত্যের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়। তাছাড়া, এর ৩০ সদস্য দেশের যে কোনো একটি দেশ ভেটো দিতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এরদোয়ানের সরকার সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্য পদের বিষয়ে তাদের আপত্তিতে জোট মিত্রদের কাছে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে কি না তা এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। কিন্তু, তুরস্কের অবস্থান, বা এই ইস্যুর মাধ্যমে কী সুবিধা নেওয়া যেতে পারে এবং সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই আলোচনা।

সদস্যপদ নিয়ে তুরস্কের সমস্যা কী?

ন্যাটোয় তুরস্কের আছে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী। দেশটি ঐতিহ্যগতভাবে এই সামরিক জোটের সম্প্রসারণকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। দেশটি মনে করে এই জোটের 'খোলা দরজা' নীতি ইউরোপের নিরাপত্তা বাড়াতে সহায়ক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, তারা ইউক্রেন ও জর্জিয়ার যোগদানের সম্ভাবনার পক্ষে কথা বলেছিল।

বার্তা সংস্থা এপি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ নিয়ে এরদোয়ানের আপত্তির পেছনে কিছু কারণ আছে।

আঙ্কারার অভিযোগ নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে, বামপন্থি, চরমপন্থি গোষ্ঠী ডিএইচকেপি-সি ও যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের সমর্থন করে আসছে স্টকহোম ও কিছুটা হলেও হেলসিঙ্কি।

আঙ্কারার আরও অভিযোগ, ২০১৬ সালে তুরস্কে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে ছিলেন এই নেতা।

তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, কয়েক দশক ধরে অনেক কুর্দি ও অন্যান্য নির্বাসিতরা সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি, গুলেনের আন্দোলনের অনেক সদস্য সম্প্রতি সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে ৩৩ জনকে ফেরতে চেয়েছে আঙ্কারা। কিন্তু, তাদেরকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

আঙ্কারা প্রায়ই তার জোট মিত্রদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ তোলে। এমনকি, তুরস্কের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণেও ক্ষুব্ধ এরদোয়ান। ২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের সামরিক অভিযানের পর ইইউ সদস্য দেশগুলো আঙ্কারার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। সেই তালিকায় সুইডেন-ফিনল্যান্ডও আছে।

এরদোয়ান বলছেন, ১৯৮০ সালে আঙ্কারা ন্যাটোর সামরিক কাঠামোয় গ্রিসকে আবার অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছিল। যা ছিল তুরস্কের জন্য একটি 'ভুল'। তার দেশ একই 'ভুলের' পুনরাবৃত্তি করতে চায় না। তিনি দাবি করেন, পরে গ্রিস ন্যাটোর সহায়তা নিয়ে 'তুরস্কবিরোধী' হয়ে উঠেছে।

তুরস্ক কী করতে পারে?

এপি'র প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন—তুরস্ক হয়তো সমঝোতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে চাইবে। যে চুক্তির অধীনে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে তুরস্কের সমর্থনের বিনিময়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে পিকেকে ও অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুরস্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হতে পারে—সিরিয়ার কুর্দি সংগঠন কুর্দি পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট বা ওয়াইপিজিকে যে কোনো ধরনের সমর্থন বন্ধ করতে হবে।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই ওয়াইপিজি পশ্চিমের মিত্র হলেও তুরস্ক মনে করে কুর্দি সংগঠনটি পিকেকে'র সঙ্গে যুক্ত।

সংবাদমাধ্যমটি আরও বলছে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদের ইস্যুকে কেন্দ্র করে জোটের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্রদের কাছ থেকে ছাড় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে তুরস্ক।

যেমন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্পে ফিরতে চায় তুরস্ক। রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার পর এই প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বাদ দেওয়া হয়।

অথবা, তুরস্ক এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের নতুন ব্যাচ কিনতে ও তাদের বিমান বহরকে সময়োপযোগী করতে চাইবে।

তুরস্কের অন্যান্য সম্ভাব্য দাবির মধ্যে থাকতে পারে—মিত্রদের আরোপিত সামরিক অস্ত্র বিক্রির ওপর অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা।

পাশ্চাত্যে তুরস্কের ভাবমূর্তিতে এর কী প্রভাব পড়বে?

তুরস্কের ভেটো দেওয়ার এই হুমকি ওয়াশিংটন ও ন্যাটোজুড়ে তার নিজস্ব অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে। কারণ, তারা নিজেদের লাভের জন্য জোটের সম্প্রসারণে বাধা দিচ্ছে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের তুরস্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সোনার কাগাপটে গণমাধ্যমকে বলেন, 'পিকেকে'র সঙ্গে যুক্ত থাকার যে অভিযোগ তুরস্ক তুলেছে তা সবাই ভুলে যাবে। বরং সবার দৃষ্টিতে থাকবে ন্যাটোর সম্প্রসারণে তুরস্কের বাধা দেওয়ার বিষয়টি। সবাই সেদিকেই মনোনিবেশ করবে। এটি তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে।'

তার মতে, ওয়াশিংটন এফ-১৬ বিক্রির ব্যাপারে 'ইতিবাচক' হতে শুরু করেছিল। কিন্তু, তুরস্কের বাধার কারণে তাও ফিরিয়ে দিতে পারে। 'আমি এই পর্যায়ে এসব যুদ্ধবিমান বিক্রির সম্ভাবনা দেখছি না,' যোগ করেন তিনি।

তুরস্ক কি রাশিয়াকে খুশি করার চেষ্টা করছে?

রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের সঙ্গে তুরস্ক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে বলা যায়, তারা উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমঝোতা চেষ্টায় প্রতিনিধিত্ব করেছে।

কাগাপটে বলেন, 'এরদোয়ান ন্যাটোর প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে লাইনচ্যুত করছেন। তিনি সম্ভবত রাশিয়াকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েও কিয়েভের সঙ্গে আলোচনার অব্যাহত রেখে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।'

এরদোয়ানের সঙ্গে জোটবদ্ধ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা দৌলত বাহসেলি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, 'ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদ রাশিয়াকে উসকে দিতে পারে। তার মতে, এটি ইউক্রেন যুদ্ধকেও উসকে দিতে পারে।'

তার মতে, সবচেয়ে ভালো বিকল্প হবে নর্ডিক দেশ ২টিকে 'ওয়েটিং রুমে' রাখা।

এই নীতি কি এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা বাড়াবে?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, দুর্বল অর্থনীতি, আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়—এসব সংকটের কারণে তুর্কি নেতার অভ্যন্তরীণ সমর্থন কমছে। বিষয়টি নিয়ে এরদোয়ান চিন্তিত ও সাবধানী পথে এগোচ্ছেন।

ইউরোপের দেশগুলোয় পিকেকে'র প্রতি সমর্থন এখানে বড় ইস্যু হতে পারে। এ কারণে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে তা এরদোয়ানের সমর্থন বাড়াতে পারে। ২০২৩ সালের জুনে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে তার প্রচারণায় সহায়তা করতে পারে।

বিশ্লেষক আসিদিন্টাসবাস ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসে প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন, এরদোয়ান এমন এক সময়ে অভ্যন্তরীণ সমর্থন হারাচ্ছেন যখন তুরস্ক একটি সমালোচনামূলক নির্বাচনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এ কারণে হয়তো বিশ্বের কাছে তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তুরস্কের ভোটারদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Ducsu 2025, a litmus test for the interim government

Ducsu 2025 is much more than a contest for student union posts. It is like a referendum on the future of student politics in Bangladesh

13m ago