মালয়েশিয়ায় কাজ নেই, বেতন নেই লাখো বাংলাদেশির

প্রতীকী ছবি। রয়টার্স ফাইল ছবি

মহামারির বিপর্যয় থেকে অর্থনীতি সচল করতে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের জন্য ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় খুলে দেওয়া ছিল আনন্দের খবর।

শ্রমিক শোষণ ও অনেক বেশি অভিবাসন ব্যয়ের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া স্থগিত করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি।

পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনতে বাংলাদেশের হাজারো তরুণ লাখ লাখ টাকা ধারকর্জ করে দেশটিতে যাওয়ার জন্য। তবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য অপেক্ষা করছিল রুঢ় বাস্তবতা। সেখানে তাদের জন্য কোনো কাজ ছিল না।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শ্রমবাজার পুনরায় খোলার পর থেকে চার লাখের বেশি বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় গেছেন। শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ৫১ হাজারের বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া।

তাদের অনেকেই এখন বেকার, বেতন নেই এবং অনেকেই কম বেতনভুক্ত।

ভাগ্যান্বেষণে আসা এমনই একজন আশাবাদী অভিবাসী শ্রমিক নেত্রকোনার জহিরুল ইসলাম। গত বছরের জানুয়ারিতে বিদেশি কর্মীদের জন্য শিথিল নিয়োগ নীতির সুবিধা নিয়ে সাত মাস আগে মালয়েশিয়া আসেন তিনি। এজন্য তার খরচ করতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা।

বিশেষ স্কিমের অধীনে, নিয়োগকর্তাদের 'নিয়োগের পূর্বশর্ত এবং যোগ্যতা কোটা' ছাড়াই তাদের বর্তমান চাহিদা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

একমাত্র শর্ত ছিল বিদেশি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেড় হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বা ৩২০ ডলার) দিতে হবে।

৩০ বছর বয়সী জহিরুল কুয়ালালামপুরের বিকস এসডিএন বিএইচডিতে একটি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ পেয়েছিলেন, যেখানে তাকে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৫০০ রিঙ্গিত দেওয়া হবে যা ওভারটাইম এবং অন্যান্য ভাতার সাথে দ্বিগুণ হতে পারে।

'কিন্তু সেখানে কাজ নাই, বেতনও নাই। আমাদের দিনে দুবার খাবার দেয়- ভাত আর ডাল,' তিনি গত ২ মার্চ কুয়ালালামপুরের একটি হোটেল থেকে ফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে এসব কথা বলেন। তিনি জানান, সেখানে তিনি এবং আরও প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি আছেন।

প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০ বাংলাদেশিকে নিয়োগ দিলেও তাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। কয়েক সপ্তাহের জন্য, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে অল্প কিছু রিঙ্গিত কিংবা অনেককে বিনা বেতনে অন্য একটি কোম্পানিতে কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

আরও কষ্টের বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি কর্মীদের পাসপোর্ট নিয়ে নিচ্ছে। ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা দিলে তারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান পরিচয়পত্র ফেরত পেতে পারেন।

কেউ হোটেল থেকে বের হলে তাকে আর ফিরতে দেওয়া হয় না এবং এভাবে তারা অবৈধ হয়ে যান। অর্থাৎ বিদেশি শ্রমিকদের হোটেলে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।

জহিরুলের সঙ্গে থাকা শাকিল খান নামে একজন সাহস করে কাজের সন্ধানে হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় কোনো কাজ তিনি পাননি।

মাগুরার ২৯ বছর বয়সী এই যুবক বাংলাদেশে থেকে ধার করে পাঠানো তার পরিবারের টাকায় এখানে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন।

'বাংলাদেশ থেকে এখানে আসতে আমি যে ঋণ নিয়েছিলাম কথা ছিল এখানে কাজ করে সেই ঋণ মোধ করার। এখন আমি নিজে বেঁচে থাকার জন্যই আরও ঋণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। এর চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে?'

মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর কয়েক মাস পর তার বাবার মৃত্যু তার উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মা, স্ত্রী আর দুই বছরের ছেলে তাদের নিজের বেঁচে থাকার জন্য যেমন অর্থের যোগানের কথা ভাবতে হচ্ছে আবার আমার জন্য এখানে টাকা পাঠানোর জন্য তাদের চিন্তা করতে হচ্ছে।

শাকিলসহ ছয়জন মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগে অভিযোগ দায়ের করে রায়ের অপেক্ষায় আছেন।

তিনি বলেন, 'আগামী দুই মাসের মধ্যে ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে না পারলে আমি নথিভুক্ত হবো না।'

অভিবাসী অধিকার কর্মী ও গবেষক অ্যান্ডি হলের হিসাব অনুযায়ী, শাকিল ও জহিরুলের মতো এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি এখন মালয়েশিয়ায় কর্মহীন, অবৈতনিক, কম বেতন ও ঋণগ্রস্ত।

হল এমন কয়েক ডজন ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন যেখানে বাংলাদেশি অভিবাসীরা সব নিয়ম মেনেও চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

কুয়ালালামপুরভিত্তিক আরেক অভিবাসী অধিকার গবেষক বলেন, এ ধরনের বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ হবে।

এতে প্রশ্ন উঠেছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার জন্য দায়ী কে।

গবেষকরা বলছেন, শিথিল নিয়মের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য ভুয়া কোম্পানি বিদেশি কর্মীদের জন্য আবেদন করে। কোম্পানিগুলো বিদেশি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসে শুধুমাত্র এই প্রক্রিয়া থেকে অর্থ উপার্জনের জন্য।

ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য নিয়োগ শিথিল হলেও অনেক নির্মাণ কোম্পানিও এক্ষেত্রে ঢুকছে।

মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই শিথিল নীতির ফলে উৎপাদন ও সেবা খাতে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

গত বছরের ২৩ অক্টোবর মালয়েশিয়ার সংবাদপত্র দ্য স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে শ্রমবাজার পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে ধারণার ৫ লাখ ১৮ হাজার বিদেশি শ্রমিকের তুলনায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৪১৮ বিদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় এসেছে।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) এর কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে সেখানে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে এবং তাদের অনেকেরই চাকরি নেই।

তারা অবশ্য বলছেন যে সংখ্যাটি কয়েক হাজার হবে -তবে গবেষকরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী সব শ্রমিকের চাকরি ও অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালয়েশিয়া সরকারের।

তিনি বলেন, আমি আশা করি, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তদন্ত করে শ্রমিকদের চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, মিশন নিয়োগকর্তাদের কাছে বেকারত্ব, বেতন না দেওয়া বা কম বেতনের অভিযোগ নিয়ে কাজ করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'ব্যর্থতার ক্ষেত্রে হাইকমিশন মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ সমাধানের জন্য নিযুক্ত করে।'

জহিরুল অবশ্য বাংলাদেশ মিশনের সহায়তা নিয়ে সন্দিহান।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা তিন মাস আগে তাদের হোটেল পরিদর্শন করে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

'তারপর থেকে কিছুই হয়নি।'

Comments

The Daily Star  | English

Protesting NBR officials observe work abstention

Tax officials nationwide abstained, demanding NBR autonomy and specific reforms

36m ago