৭৬ বছর পরও প্রজ্জ্বল চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্র

ছবি: শেখ নাসির/স্টার

১৯৪৯ সালের ১৬ জুলাই। ছিয়াত্তর বছর আগে এই দিনে চট্টগ্রামে এ অঞ্চলে প্রথম চা নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনাটি দেশের চা শিল্পের ইতিহাসের একটি মাইলফলক। সেদিন চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্রের জন্ম হয়। এটি এখনো দেশের চা বাণিজ্যের সিংহভাগ পরিচালনা করে।

দেশে প্রথম চা চাষ শুরু হয় চট্টগ্রামে ১৮৪০ সালে। পরে এর প্রসার ঘটে সিলেটে। এরপর এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে উৎপাদিত চা পাঠানো হতো কলকাতা ও লন্ডনের নিলাম কেন্দ্রে।

১৯ শতকের শেষ দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন এবং আসাম পর্যন্ত এর বিস্তৃতি হলে আসাম ও সিলেটের চা বাগান মালিকেরা কলকাতা বন্দরের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চা রপ্তানি শুরু করেন। ফলে ওই সময় থেকেই চট্টগ্রামে চায়ের গুদামসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে ওঠে।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নতুন দেশে নিজেদের মাটিতে নিলাম কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন স্থানীয় চা বাগান মালিকেরা।

১৯৪৮ সালের ৬ জুন এ অঞ্চলে উৎপাদিত চা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত চারটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান—ডব্লিউএফ ক্রেসওয়েল, জে থমাস, এডব্লিউ ফিগিস ও ক্যারিট মোরান স্থানীয় ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান ব্রোকার্স লিমিটেড (পরে ন্যাশনাল ব্রোকার্স লিমিটেড) প্রতিষ্ঠা করেন। এর এক বছর পর এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বন্দরনগরীতে প্রথম নিলামের আয়োজন হয়।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এবং টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিটিএবি) আয়োজনে বর্তমানে প্রতি চা নিলাম বর্ষে এপ্রিল থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি সোমবার চট্টগ্রামে সাপ্তাহিক নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৮ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ও ২০২৩ সালে পঞ্চগড়ে নতুন নিলাম কেন্দ্র করা হলেও চট্টগ্রামের নিলাম কেন্দ্রের প্রভাব এখনো একচ্ছত্র।

চা বোর্ডের তথ্য বলছে—২০২৪-২৫ মৌসুমে নিলামে বিক্রি হওয়া আট কোটি ৭২ লাখ কেজি বা ৯৭ শতাংশের বেশি চা বিক্রি হয়েছিল চট্টগ্রাম দিয়ে। শ্রীমঙ্গলের নিলাম কেন্দ্রে এক দশমিক ২৪ মিলিয়ন কেজি ও পঞ্চগড়ের নিলাম কেন্দ্রটি এক দশমিক ১২ মিলিয়ন কেজি চা বিক্রি হয়েছে।

বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরান তানভীরুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা রপ্তানি কমে গেলেও বাংলাদেশের চা বাণিজ্য মূলত চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। বেশিরভাগ ক্রেতা এখনো এখান থেকে চা কিনতে পছন্দ করেন।'

টিটিএবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. ইউসুফের মতে, এর মূল কারণ অবকাঠামোগত সুবিধা।

চট্টগ্রামের ১৬টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত গুদাম আছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের বাগানের চা নিলামের আগে এসব গুদামে সংরক্ষণ করা হয়।

সেই তুলনায়, মৌলভীবাজারে ছয়টি ও পঞ্চগড়ে তিনটি গুদাম আছে।

'গুদামজাতকরণ-মান নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো চট্টগ্রামে আছে। এ কারণে চাষি ও ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম,' বলেন মো. ইউসুফ।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে বড় বড় ক্রেতাদের ব্লেন্ডিং কারখানা ও গুদাম সুবিধার পাশাপাশি নিলাম পরিচালনার জন্য অনুমোদিত সাত ব্রোকিং প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ও আছে।

চা
মৌলভীবাজারের সাতগাঁও চা-বাগান। ছবি: শেখ নাসির/স্টার ফাইল ফটো

বাগান থেকে নিলামে বিক্রির জন্য চট্টগ্রামে গুদামগুলোতে চা পাঠানোর পর ব্রোকিং প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লটের নমুনা সংগ্রহ করে। এসব প্রতিষ্ঠানে পেশাদার চা টেস্টাররা পাতা ও চায়ের মান পরীক্ষা করেন এবং সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণ করেন।

এই নমুনাগুলো নিলামের এক সপ্তাহেরও বেশি আগে প্রধান ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়। দামসহ বিশদ বিবরণের ক্যাটালগও দেওয়া হয়।

প্রতি সোমবার ইস্পাহানি, আবুল খায়ের, মেঘনা, এইচআরসি, টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ (বেঙ্গল টি), লিপটন, ড্যানিশসহ অর্ধশতাধিক ক্রেতা-প্রতিষ্ঠান নিয়মিত নিলামে অংশ নেয়। এছাড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য জেলার খোলা চায়ের ক্রেতারাও এতে অংশ নেন।

সরকারি নীতি অনুসারে—চা চাষিদের উৎপাদিত পণ্যের কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ নিলামে বিক্রি করতে হয়। বাকিটা চা বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে বাগান থেকে সরাসরি বিক্রি করা যায়।

ন্যাশনাল ব্রোকার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওরমান রাফে নিজামের মতে, 'গত ৭৬ বছর ধরে চট্টগ্রাম নিলামকেন্দ্র সুনাম ধরে রেখেছে। কারণ সাত ব্রোকিং প্রতিষ্ঠান নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে উৎপাদনকারী ও ক্রেতা উভয়কেই সেবা দিয়ে আসছে।'

চা রপ্তানি কমে যাওয়া, নিলামে দরপতনসহ নানা সংকটে আছে এই শিল্প। তবুও চট্টগ্রাম চা নিলামকেন্দ্র ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। চায়ের চাহিদা ও জোগানের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসেতু এই নিলামকেন্দ্রটি। এখান থেকেই আসে চা-প্রেমীর এক কাপ চায়ের পাতা।

Comments

The Daily Star  | English
Local gold price hiked

Gold hits all-time high

From tomorrow, each bhori of 22-carat gold will cost Tk 181,487

1h ago