গাজীর কারখানা পুড়ে ছাই, ভারী যানবাহনের টায়ার উৎপাদনে মেঘনা

মেঘনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেঘনা ইনোভা রাবার কোম্পানি লিমিটেড টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সম্প্রসারিত কারখানায় ট্রাক, বাস ও কৃষি টায়ার উৎপাদন করছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া গাজী অটো টায়ারসের শূন্যতা পূরণ করার প্রত্যাশা করছে তারা।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকারে মেঘনা ইনোভার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো. লুৎফুল বারী বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে ভারী যানবাহনের টায়ার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, ঠিক যেভাবে মোটরসাইকেলের টায়ারের ক্ষেত্রে হয়েছে।'

'যথাযথ নীতিগত সহায়তা পেলে আমরা এই খাতে আমদানির প্রয়োজন পুরোপুরি দূর করতে পারব,' তিনি যোগ করেন।

মেঘনার আগে ভারী যানবাহনের টায়ারের বাজারে আধিপত্য ছিল গাজী অটো টায়ারসের। ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের রূপগঞ্জ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের কারণে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি বাজারে বাস ও ট্রাক টায়ারের ১৫-২০ শতাংশ এবং মিনিবাস টায়ারের ৬৫ শতাংশ দখল করেছিল।

সামগ্রিকভাবে, গাজী টায়ারস রিকশা, থ্রি-হুইলার ও ছোট বাণিজ্যিক যানবাহনের টায়ারের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করত। তাদের রূপগঞ্জ কারখানা ধ্বংস হওয়ায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় এবং প্রায় দুই হাজার ৬৫০ জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন।

শিল্পখাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, ভারী যানবাহনের টায়ারের বাজার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এবং এর ৯০ শতাংশের বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়।

এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে গাজী টায়ারসের শূন্যতা পূরণে সক্ষম হবে বলে আশা করছে মেঘনা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া মেঘনার মির্জাপুর কারখানায় জার্মানি, ইতালি ও চীন থেকে আনা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমানে এখানে ভারী যানবাহনের জন্য বায়াস টায়ার উৎপাদন করা হচ্ছে, যার লক্ষ্য আমদানি নির্ভরতা কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা।

বারী জানান, মির্জাপুর কারখানাটি ৬৫ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠিত এবং আরও ৫ বিঘা সম্প্রসারণের জন্য রাখা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোতে ইতোমধ্যে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

বর্তমানে এখানে দেড় হাজার শ্রমিক কর্মরত এবং সম্প্রতি আরও ৩০০ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে মোট বিনিয়োগ দুই হাজার ১০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে এবং আরও ৫০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বারী জানান, মেঘনা গ্রুপ ২০২৬-২৭ অর্থবছরের মধ্যে কারখানা আরও সম্প্রসারণের জন্য অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এর আওতায় উন্নত টায়ার প্রযুক্তি চালু ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

কোম্পানিটি দীর্ঘপথ পরিবহনের জন্য টেকসই টায়ারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে একটি বিশেষায়িত রেডিয়াল টায়ার (টিবিআর) কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছে।

বর্তমানে বাস ও ট্রাকের টায়ার উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান মাত্র কয়েকটি। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনা ইনোভা, অ্যাপেক্স হোসেন লিমিটেড, রূপসা টায়ার, হাসান রাবার, পানামা রাবার ও যমুনা টায়ার (যারা মূলত যাত্রীবাহী গাড়ির রেডিয়াল ও টিবিআর টায়ার তৈরি করে)। তারপরও খরচ ও নীতিগত সুবিধার কারণে বাজারে আমদানিকৃত টায়ারের আধিপত্য বেশি।

বারী উল্লেখ করেন, বিশেষ করে কৃষি টায়ারের শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত আমদানির কারণে এই খাত এখনো ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'আমদানিকৃত কৃষি টায়ারে ভ্যাট বা শুল্ক নেই। অথচ, আমরা কাঁচামাল ও টায়ারের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক দিই। এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।'

সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি তার আহ্বান, হয় আমদানিকৃত কৃষি টায়ারের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে হবে অথবা দেশীয়ভাবে উৎপাদিত টায়ারের ওপর ভ্যাট মওকুফ করতে হবে।

এ ছাড়া, দেশীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আমদানিকৃত টায়ার ও টিউবের ওপর ১৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক ও সম্পূরক কর আরোপের সুপারিশ করেন তিনি।

মেঘনার মির্জাপুর কারখানাটি জার্মানি, চীন ও ভারতের টেকনিক্যাল কনসালট্যান্টদের সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে।

বারী বলেন, 'আমাদের বিশ্বমানের একটি পরীক্ষাগার রয়েছে। প্রতিটি টায়ার মডেল বাজারে আসার আগে কঠোর রোড সিমুলেশন ও মান পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়।'

মেঘনা ইনোভা কৃষি ও অফ-দ্য-রোড টায়ার উৎপাদন করছে, যার মধ্যে বড় আকারের ২৮ ইঞ্চি ট্রাক্টর টায়ারও রয়েছে।

উৎপাদন টেকসই রাখতে কোম্পানিটি বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে রাবার সংগ্রহ করে, ব্যবহৃত টায়ার পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে রাবার তৈরি করে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি—যেমন: সৌর প্যানেল ও ফ্লু-গ্যাসভিত্তিক বাষ্প ব্যবহার করে।

তবে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ পেতে দেরি হওয়ায় কোম্পানিটি এখনো আংশিকভাবে এলপিজি-চালিত বয়লারের ওপর নির্ভর করে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

বারী বলেন, 'আমরা যদি গ্যাস সংযোগ পাই, তাহলে জ্বালানি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমবে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও বাড়বে।'

তিনি বলেন, 'স্থানীয়ভাবে টায়ার উৎপাদন হলে ভোক্তারা স্পষ্টতই অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। দেশে তৈরি ট্রাক ও বাসের টায়ার আমদানিকৃত টায়ারের চেয়ে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা কম দামে পাওয়া যায়। মোটরসাইকেলের টায়ারও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম দামে পাওয়া যায়।'

দাম ছাড়াও এই উদ্যোগের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন বারী।

তিনি বলেন, 'দেশের শিল্পভিত্তি সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অটোমোটিভ যন্ত্রাংশের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে দেশীয় উৎপাদন বাড়ালে সরবরাহ সংকট ও বাণিজ্য ঘাটতির ঝুঁকি কমবে।'

তিনি আরও বলেন, 'যথাযথ নীতিগত সহায়তা পেলে বাংলাদেশ ট্রাক, বাস ও কৃষি যানবাহনের টায়ারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে।'

বারী বলেন, 'এর মাধ্যমে দেশীয় শিল্প শক্তিশালী হবে শুধু তাই না, হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং লাখ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

10m ago