শখ থেকে উদ্যোক্তা, ট্রাভেল আইকন সাদিয়ার গল্প

করপোরেট দুনিয়ায় সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে অনিশ্চিত উদ্যোক্তা জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস খুব কম মানুষই করে। কিন্তু ঝুঁকিটাই নিয়েছেন শেয়ারট্রিপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাদিয়া হক।
গ্রামীণফোন, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট, নকিয়া ও বাংলালিংকের মতো প্রতিষ্ঠানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কেটিং ও লিডারশিপের অভিজ্ঞতা ছিল তার। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সুনাম ও স্বাচ্ছন্দ্য সবই ছিল, যা অনেক পেশাজীবীর স্বপ্ন। কিন্তু সাদিয়া চেয়েছিলেন নতুন কিছু করতে।
এই স্বপ্নই তাকে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ট্রাভেল-টেক উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার গল্প শুধু একটি ট্রাভেল বুকিং কোম্পানি গড়ে তোলার নয়; বরং এক বিচ্ছিন্ন ও অফলাইনভিত্তিক খাতকে ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে রূপান্তরের গল্প।
এ বছরের বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে বর্ষসেরা নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন সাদিয়া হক। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে প্রতি বছর ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ও দ্য ডেইলি স্টার যৌথভাবে এ পুরস্কার আয়োজন করে। এটি এই পুরস্কারের ২৩তম আয়োজন।
২০১৪ সালে সাদিয়া ও তার স্বামী কাশেফ রহমান 'ট্রাভেল বুকিং বাংলাদেশ' দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। দুজনই নিয়মিত ভ্রমণ করতেন। পরিকল্পনায় থাকতো কম বাজেটে ভ্রমণ। তখন তারা বুঝতে পারেন ভিসা, হোটেল বুকিং, ট্যুর—এসব প্রক্রিয়া অনেক ঝামেলার। তখন তারা এমন একটি প্ল্যাটফর্মের কথা ভাবলেন, যা ভ্রমণের ঝক্কি-ঝামেলাকে সহজ করে দেবে।
প্রথম দিকে কাজ ছিল অফলাইনে। পরে ২০১৬ সালে প্রথম অ্যাপ চালু হয়, যেখানে শুধু হোটেল বুকিংয়ের অপশন ছিল। ২০১৮ সালে প্রথম বিনিয়োগকারী পান তারা। এরপর নতুন করে ব্র্যান্ডিং করেন, 'ট্রাভেল বুকিং বাংলাদেশ' নাম বাদ দিয়ে দেন নতুন নাম—'শেয়ারট্রিপ'। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আইওএস, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ও ওয়েবসাইটসহ বাণিজ্যিকভাবে চালু হয় পুরো প্ল্যাটফর্ম।
উদ্ভাবন
তখনো বাংলাদেশে ট্রাভেল ব্যবসা ছিল অফলাইন এজেন্টদের দখলে। ভ্রমণকারীরা স্থানীয় প্ল্যাটফর্মে আস্থা রাখতেন না। কিন্তু তারা নতুন ফিচার আনেন—গ্যামিফিকেশন, লয়্যালটি প্রোগ্রাম এবং প্যাকেজড সার্ভিস। এতে শেয়ারট্রিপ হয়ে ওঠে অনন্য।
কোভিড-১৯ ধাক্কা
মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রিতে ধস নামে। কিন্তু শেয়ারট্রিপ দ্রুত নতুন পথে হাঁটে। তারা চালু করে বিটুবি মডেল, যেন ছোট এজেন্টরা ঘরে বসেই টিকিট বিক্রি করতে পারে। পাশাপাশি চালু করে এসটি রুমস, যেখানে এখন দেড় হাজারের বেশি হোটেল যুক্ত আছে। এর ফলে তারা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে কেবল টিকেই থাকেনি, বরং ব্যবসা বাড়িয়েছেন।
বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ
শেয়ারট্রিপ এরপর নতুন বিনিয়োগ পায়। স্টার্টআপ বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মোট ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ পায়। এটি বাংলাদেশের ট্রাভেল-টেক খাতে অন্যতম বড় বিনিয়োগ। পরে তারা চালু করে 'এসটিপে', যা ভ্রমণ ঋণ, ইনস্যুরেন্স, ইএমআই সুবিধা ও বিভিন্ন রিটেইল ব্র্যান্ডের পার্টনারশিপ নিয়ে কাজ করছে।
চ্যালেঞ্জ
তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল প্রযুক্তি নয়, বরং নীতিগত অস্পষ্টতা ও জটিল নিয়ম। ভিসা, এভিয়েশন ও ট্যুরিজম আলাদা আলাদা নীতিতে চলে। একসঙ্গে ডিজিটাল সমাধান দিতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে বাড়তি সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে সাফল্য সব সন্দেহ দূর করেছে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
এ পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি বার শেয়ারট্রিপের অ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে। তারা এরই মধ্যে দুবাইয়ে শাখা খুলেছে—বাংলাদেশের প্রথম ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছে।
২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডসে শীর্ষ অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২২ সালে পেয়েছে 'ডিজিটাল কমার্স অব দ্য ইয়ার'-এর সম্মান।
সাদিয়া হকের মতে, সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—'কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবে ঠিকমতো চলে না, পরিবর্তনকে দ্রুত মানিয়ে নিতে হয়। এটিই টিকে থাকার একমাত্র উপায়।'
তার কাছে এই যাত্রা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের গল্প নয়, বরং বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ও ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভ্রমণ ভালোবাসতাম বলেই শুরু করেছিলাম। এখন আমরা তা চালিয়ে যাচ্ছি, কারণ লাখো মানুষ তাদের ভরসা আমাদের ওপর রেখেছে। এটা আমাদের জন্য গর্ব, আর দায়িত্ব।
Comments