‘ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়’

যে সময়ে এসে ব্যবসা আর রাজনীতির মাঝে সীমারেখা খুঁজে পাওয়া কঠিন, তখনও নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশের করপোরেট ইতিহাসের অন্যতম সম্মানিত নাম এম আনিস উদ দৌলা—অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (এসিআই) লিমিটেডের চেয়ারম্যান। তিনি বিশ্বাস করেন, এই দুটি ক্ষেত্র আলাদা থাকা উচিত এবং তার নিজের ক্যারিয়ারই এর প্রমাণ।
এ বছরের বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে 'আজীবন সম্মাননা' প্রদান করা হয়েছে আনিস উদ দৌলাকে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে প্রতি বছর ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ও দ্য ডেইলি স্টার যৌথভাবে এ পুরস্কার আয়োজন করে। এটি ছিল এই পুরস্কারের ২৩তম আয়োজন।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আনিস উদ দৌলা বলেন, 'ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়। রাজনীতি আমাদের কাজ না। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি দেশের জন্য সম্পদ সৃষ্টি করতে। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের সামলাতে দিন।'
তার পেশাগত জীবনের শুরু উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, বরং পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে। নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করে যে দক্ষতা তিনি অর্জন করেছেন, সেটাই পরবর্তীতে তার উদ্যোক্তা জীবনকে আরও সফল করেছে।
শুরু দিকের কথা স্মরণ করে আনিস উদ দৌলা বলেন, 'আমি সবসময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম—উৎপাদনশীলতা বাড়াতাম, খরচ কমাতাম, নতুন উদ্ভাবনের উপায় খুঁজতাম। কখনও এর জন্য প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি নিয়েছি, আবার অনেক সময় নিজে থেকেই করে ফেলেছি।'
১৯৯২ সালে ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (আইসিআই) যখন বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কোম্পানিটি তাকে এক অস্বাভাবিক প্রস্তাব দেয়—আয় করে মূল্য পরিশোধের। এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি লুফে নেন—জন্ম নেয় এসিআই।
আনিস উদ দৌলা বলেন, 'এটি ছিল দারুণ এক চুক্তি। সেই মুহূর্ত থেকে আমি উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম।'
বর্তমানে এসিআই ২৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যালস, ভোক্তা ব্র্যান্ড, কৃষি ও লজিস্টিকস খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ২৯ হাজারের বেশি মানুষ কর্মরত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তাদের প্রবৃদ্ধি কখনোই রাজনৈতিক প্রভাবের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
প্রাথমিক মূলধন সম্পর্কে জানতে চাইলে আনিস উদ দৌলা বিনম্রভাবে বলেন, 'আমার মূলধন ছিল আমার মেধা ও পরিশ্রম।'
এসিআই রাইট ইস্যু ও ঋণের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করলেও কৌশলগতভাবে সম্পদের ব্যবহার ও অটল মূল্যবোধ তাদের প্রধান শক্তি।
তিনি বলেন, 'আমরা লক্ষ্য স্থির করেছিলাম মানুষের জীবনমান উন্নত করার। আমাদের মূল্যবোধ ছিল—গুণগত মান, গ্রাহককেন্দ্রিকতা, উদ্ভাবন, ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিক উন্নয়ন। এগুলো শুধু শব্দ নয়—আমরা এগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছি।'
তার নেতৃত্বে এসিআই প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে আইএসও ৯০০১ সনদ অর্জন করে—যা গুণগত ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রমাণ।
৬৫ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আনিস উদ দৌলা বলেন, 'সাফল্যের কোনো শর্টকাট নেই। কঠোর পরিশ্রম, আবেগ ও নৈতিক সততা—এর কোনো বিকল্প নেই।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাফল্যকে অবশ্যই নৈতিক নেতৃত্ব, গ্রাহককেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারাবাহিক শেখার সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, 'গ্রাহকরাই রাজা। তাদের ছাড়া আমরা অনাথ। আমাদের শুধু পণ্য বিক্রির দিকে নয়, তাদের সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে।'
ব্যবসা ও রাজনীতির সীমারেখা
রাজনীতির প্রশ্নে আনিস উদ দৌলা আপসহীন। তিনি মনে করেন, 'নীতিমালা অবশ্যই জনগণমুখী, প্রবৃদ্ধিমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী হতে হবে। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থের আগে জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে স্থান দিতে হবে।'
তবে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তার বার্তাটি আরও স্পষ্ট, 'রাজনীতি থেকে দূরে থাকুন। এটা আপনার জায়গা না। আপনার কাজ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সম্পদ উৎপাদন করা এবং দেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করা।'
তিনি রাজনীতি ও ব্যবসার 'বিপজ্জনক' সংমিশ্রণের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, এর ফলে যোগ্যতার জায়গায় প্রভাব স্থান পায় এবং সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আনিস উদ দৌলা বলেন, 'রাজনীতি কোনো জীবিকা না। এটা সেবা। আপনি যদি আপনার নিজ নিজ ক্ষেত্রে বড় কিছু অর্জন করতে পারেন এবং সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চান, তাহলে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারেন। টেন্ডার বা কন্ট্রাক্টের জন্য রাজনীতি নয়, বরং সেবার জন্য রাজনীতি করতে হবে।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ উৎপাদন—এসবের বেশিরভাগই আসে বেসরকারি খাতের উদ্যোগ থেকে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এসব প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সহায়তা দিতে হবে।'
আনিস উদ দৌলা বলেন, এসিআইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর কর্মী। 'কর্মীরাই আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আমরা তাদের এসিআই পরিবারের অংশ বলে মনে করি। তাদের উৎসাহ দিই, সম্মান করি এবং তাদের অবদান স্মরণ করি।'
তার মতে, নেতৃত্বের মূল কাজ হলো কর্মীদের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করা।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রায়ই বলি—এসিআইতে কেউ যোগ দিলে, সে পরিবারের অংশ হয়ে যায়। আমরা সবাই একসঙ্গে আছি।'
উদ্যোক্তাদের জন্য তার পরামর্শ সহজ—'কাজকে ভালোবাসুন, চেষ্টা করুন, আবার চেষ্টা করুন। যদি কাজকে ভালোবাসেন, তাহলে অবসরও কাজ হয়ে যায়।'
তিনি 'ব্যর্থতা'কে শেষ নয়, বরং 'শিক্ষা' হিসেবে দেখেন। 'ব্যর্থতা আসে অমনোযোগিতা বা আত্মতুষ্টি থেকে। নিজের প্রচেষ্টার পুনর্মূল্যায়ন করুন, ভুল থেকে শিক্ষা নিন এবং নতুন করে শুরু করুন। অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই সাফল্য আসবে।'
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে আশাবাদী আনিস উদ দৌলা। তবে, তিনি সতর্ক করেছেন, স্থবিরতা কোনো বিকল্প নয়। 'স্থবির ব্যবসা মানেই মৃত ব্যবসা। এগিয়ে যেতে হলে আমাদের কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে, উদ্ভাবন করতে হবে এবং উৎকর্ষের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।'
তার কাছে ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সরকার ও ব্যবসার মধ্যে অংশীদারিত্বের ওপর, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর নয়। 'আমাদের জাতির সাফল্য নির্ভর করে সহযোগিতার ওপর। সরকারি নীতিমালা দিয়ে বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষমতায়ন করতে হবে, দুর্বল নয়।'
বয়স হলেও আনিস উদ দৌলা এখনো কাজে ব্যস্ত থাকেন। আশির কোঠায় পৌঁছেও তিনি অবসরে না গিয়ে কাজের ব্যস্ততাতেই দিন কাটান।
'আমি আমার কাজটা ভালোবাসি। এখান থেকেই শক্তি পাই। আমার কাছে অবসরের কাজ হলো কোম্পানি ও নতুন ধারণা নিয়ে ভাবা।'
তিনি প্রচলিত ধরনের বিশ্রামে খুব বেশি সময় ব্যয় করেন না। বরং সময় দেন পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নে।
'জীবন ছোট্ট। আমাদের উচিত এর সর্বোত্তম ব্যবহার করা। যদি ফলপ্রসূভাবে বাঁচি, তাহলে আল্লাহ আমাদের যে জীবন দিয়েছেন তার মর্যাদা দেওয়া হবে। আমাদের দায়িত্ব মানবজাতির সেবা করা।'
আনিস উদ দৌলার জীবনগাথা শুধু করপোরেট সাফল্যের গল্প নয়, বরং নৈতিকতা, মানবিকতা ও জাতীয় অগ্রগতির প্রতি এক গভীর প্রতিশ্রুতির কাহিনী।
তার ভাষ্য, 'রাজনীতিবিদদের জনগণের সেবা করতে দিন, আর ব্যবসায়ীরা অর্থনীতি গড়ে তুলুন।'
Comments