নভেম্বরে খুলছে সেন্টমার্টিন, কিন্তু ‘আসল মৌসুম’ শুরু ডিসেম্বরে
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সেন্টমার্টিন মাসব্যাপী বন্ধ থাকার পর আগামী সপ্তাহে পুনরায় খুলে দেওয়া হচ্ছে। এতে পর্যটকেরা আবারও বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের শান্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
তবে এই খবর স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য খুব একটা উৎসাহ নিয়ে আসেনি, যদিও পর্যটন তাদের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস। তাদের জন্য এই মৌসুম ডিসেম্বরের আগে শুরু হয় না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ২২ অক্টোবর জারি করা এক বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, সরকার পর্যটকদের ভ্রমণের অনুমতি দিলেও নভেম্বরে কাউকে রাত্রিযাপনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এতে ১২টি শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও রয়েছে।
এ ছাড়া, সরকারের নতুন সংরক্ষণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই মৌসুমে দৈনিক দর্শনার্থীর সংখ্যা দুই হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। জাহাজ চলাচলও কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়েছে।
সেন্টমার্টিনে যেকোনো জাহাজ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে টিকিট কিনতে হবে, যা এখনও কার্যকর হয়নি। প্রত্যেক দর্শনার্থীর একটি ভ্রমণ পাস এবং একটি কিউআর কোড বহন করতে হবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পর্যটনের পূর্ণ মৌসুম চলবে। এই সময়ে দ্বীপে রাত্রিযাপনও করা যাবে। ফেব্রুয়ারিতে দ্বীপটি আবার বন্ধ হয়ে যাবে।
নভেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে রিসোর্ট পরিচালনাকারীদের খুব বেশি উৎসাহ থাকে না। সর্বোপরি, খুব কম পর্যটকই আধা দিনের জন্য ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক।
দ্বীপের উত্তর দিকে অবস্থিত মারমেইড সেন্টমার্টিন রিসোর্টের ব্যবস্থাপক তৈয়বুল উল্লাহ বলেন, 'আমরা পর্যটকদের কাছ থেকে অনেক ফোনকল পাচ্ছি। তারা জানতে চান, নভেম্বরে এখানে থাকতে পারবেন কি না। যেহেতু অনুমোদন নেই, তাই আমরা বুকিং নিতে পারছি না। যদি মানুষ থাকতে না পারে, তাহলে এটাকে পর্যটনের মৌসুম বলা যাবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'ডিসেম্বর-জানুয়ারি আমাদের প্রধান পর্যটন মৌসুম। আমরা নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সংস্কার এবং সাজসজ্জার কাজসহ প্রস্তুতি শুরু করব। বিছানার চাদর এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কাছাকাছি সময়ে কেনা হবে। আমরা যদি খুব তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিই, তবে তা নষ্ট হবে।'
পর্যটকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল দ্বীপবাসীর জন্য এখন পর্যটনের মূল মৌসুম মাত্র দুই মাস। তৈয়বুল উল্লাহ বলেন, 'এখানকার অনেক পরিবার সম্পূর্ণভাবে পর্যটন মৌসুমের ওপরই জীবন নির্ভর করে। যদি আমরা শুধু ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ব্যবসা চালাই, তাহলে সেই আয় পুরো বছরের জন্য যথেষ্ট হয় না। এতে জীবন খুবই কঠিন হয়ে যায়।'
পর্যটন মৌসুমে সাধারণত কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের মধ্যে প্রায় আট থেকে দশটি জাহাজ চলাচল করে। এর মধ্যে দুইটি পরিচালনা করে কর্ণফুলি গ্রুপ। জাহাজের পরিচালক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, 'আমাদের কার্যক্রম এখন অনিশ্চিত।'
বাহাদুর বলেন, 'আমরা নভেম্বরের কার্যক্রম নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। যদি কোনো জাহাজ সকাল ৭টায় কক্সবাজারের বিআইডব্লিউটিএ জেটি থেকে ছাড়ে, সেটি দ্বীপে পৌঁছায় প্রায় দুপুর ২টার দিকে। আমাদের জাহাজগুলোর প্রায় সাত ঘণ্টা লাগে, কিন্তু অন্যদের প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। একই দিনে যাওয়া-আসা প্রায় অসম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'পর্যটকেরাও এত কম সময়ের জন্য যেতে আগ্রহী নন। আর এটি বাস্তবসম্মতও নয়। এর ওপর আবার পর্যটকদের জন্য নিবন্ধন ওয়েবসাইট এখনও চালু হয়নি, তাই কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।' তিনি আশা করছেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মূল মৌসুম শুরু হলে কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে চলবে।
চট্টগ্রামের কিছু ক্রুজ অপারেটর নির্দিষ্ট দিনে রাত্রিকালীন প্যাকেজ অফার করে, যেখানে পর্যটকরা দ্বীপের কাছে নোঙর করা জাহাজে থাকতে পারেন। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, পর্যটকের এই সংখ্যা খুবই কম। দ্বীপের শত শত ছোট রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ এবং দোকানের ব্যবসার জন্য এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়।
দ্বীপের গ্রিন বিচ রিসোর্টের মালিক মো. সোহেল বলেন, 'নভেম্বরে খুব বেশি পর্যটক আসবেন, তা আমরা আশা করি না। তবে আমরা ডিসেম্বর ও জানুয়ারির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিচ্ছি।'
তবে পর্যটনের মৌসুম পুরোপুরি চালু হলেও কিছু শঙ্কা থাকে রিসোর্ট মালিকদের। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার পর্যটককে রাত্রিযাপনের অনুমতি দিলে আমার মতো ছোট, স্থানীয় মালিকানাধীন রিসোর্টগুলোর ব্যবসা সীমিত হবে। বেশিরভাগ দর্শনার্থী সমুদ্র সৈকতের কাছে বাইরের বিনিয়োগকারীদের নির্মিত বড় রিসোর্টগুলোতে থাকতে পছন্দ করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'দ্বীপটিতে প্রায় আট থেকে ১০ হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য ছোট রিসোর্টগুলোকে সম্ভবত ছাড় দিতে হবে। এর ফলে খরচ মেটানো কঠিন হতে পারে।'
সরকার বারবার দ্বীপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষার বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। পরিবেশবিদরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন— বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত হোটেল নির্মাণ, বর্জ্য ডাম্পিং এবং প্রবাল উত্তোলন— দ্বীপের নাজুক বাস্তুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
কক্সবাজারের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য পর্যটন কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।
তিনি বলেন, 'পর্যটন মন্ত্রণালয় দর্শনার্থীদের জন্য অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালুর জন্য কাজ করছে। দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য সমস্ত কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।'
এ মুহূর্তে স্থানীয়দের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। নভেম্বরের শুরুতে অনুমোদিত নৌযানগুলো যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেও বেশিরভাগ রিসোর্ট মালিক এখনো তাদের দরজা বন্ধ রেখেছেন। তাদের সময় কাটছে ঢেউয়ের গর্জন শুনে আর পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে।


Comments