অঙ্গীকার থেকে বাস্তব: মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৬ বছরের নির্ভরতার গল্প
'মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি (এমটিবি) তার নামের মর্যাদা রক্ষা করেছে গত ২৬ বছরে। ব্যাংকটি কখনো প্রতিশ্রুত ১০ টাকার বদলে ৯ টাকা দেয়নি। এত বছরে ব্যাংকে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটেনি।' এমটিবির ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
এমটিবি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন পায় ১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর। একই মাসে তারা কার্যক্রম শুরু করে। এখন তৃতীয় প্রজন্মের এই বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকটির ১২২টি শাখা, ৫৩টি উপ-শাখা, ১৮৫টি এজেন্ট ব্যাংকিং সেন্টার, ৩৪৪টি এটিএম, ৩১টি ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন, ৮টি এয়ার লাউঞ্জ, ৪টি মানি এক্সচেঞ্জ বুথ এবং ৩ হাজার ৩০০টির বেশি পয়েন্ট অব সেল টার্মিনাল আছে।
গ্রাহকদের জন্য রিয়েল-টাইম অনলাইন ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ও এসএমএস সেবা দিচ্ছে এমটিবি। ২৭তম বছরে পদাপর্ণ করে ব্যাংকটি ডিজিটালি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে মনোযোগ দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আস্থা ও সুশাসনের সুনাম বজায় রাখতে চাইছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, '২৬ বছরে আমরা নির্ভরযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও সেবার ওপর একটি ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছি। এখন আমরা এই আস্থা প্রযুক্তিনির্ভর, গ্রাহককেন্দ্রিক অভিজ্ঞতায় রূপ দিতে চাই।'
তিনি বোর্ড অব ডিরেক্টরদের প্রশংসা করে বলেন, 'বোর্ড সবসময় নতুন ধারণাকে উৎসাহিত করেছে, আবার নিয়ম-শৃঙ্খলাও নিশ্চিত করেছে। এই ভারসাম্যই আমাদের স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করেছে।'
তার মতে, এমটিবি এখন একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যাংক থেকে বহুমুখী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে রিটেইল ব্যাংকিং, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) ও করপোরেট খাত সবই শক্তিশালী। তিনি বলেন, 'আমরা শুধু আকারেই বাড়ছি না, মানসিকভাবেও বদলাচ্ছি।'
এ বছর ব্যাংকটি নতুন লোগো ও রঙ নিয়ে আবার নতুন করে ব্র্যান্ডিং করেছে। ব্যাংকটি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে চায়, যারা গতি, সুযোগ-সুবিধা ও ডিজিটাল সেবাকে মূল্যায়ন করে। এমটিবির সিইও বলেন, 'সেই সঙ্গে আমরা আমাদের মূল প্রতিশ্রুতি— আস্থা বা বিশ্বাসও অটুট রেখেছি। চেহারায় নতুনত্ব এরই ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তনের প্রতীক।'
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এমটিবির মোট আমানত ছিল ৩৩ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা এবং ঋণ ও অগ্রিম ছিল ৩০ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকটির সম্মিলিত মুনাফা দাঁড়ায় ৫৬৯.৮৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
যখন অনেক ব্যাংকে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ঋণখেলাপির মতো সমস্যা চলছে, তখনও এমটিবি এসব ঝুঁকি থেকে দূরে থেকে তার সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এর কারণ আমরা সবসময় নিয়ম মেনে চলেছি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিয়েছি। স্বল্পমেয়াদি লাভের চেয়ে সুনামকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।'
রিটেইল ব্যাংকিং এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে ঋণ দেওয়াই ব্যাংকের প্রবৃদ্ধির প্রধান ক্ষেত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিটেইল ব্যাংকিং উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে ক্রেডিট কার্ড ও গৃহ ঋণ খাতে।
এমটিবি এখন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর মধ্যে আছে। আর হোম লোন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের বৃদ্ধি ঘটেছে বলে জানান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
ব্যাংকটি ৪৮ ঘণ্টায় হোম লোন অনুমোদন ও প্রি-অ্যাপ্রুভড ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমরা সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ সেবা দিতে চাই।'
এসএমই ব্যাংকিংয়ে ছোট উদ্যোক্তাদের, বিশেষত উৎপাদন ও সেবা খাতে আরও গভীরভাবে যুক্ত হতে চায় এমটিবি। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমরা ফিনটেক পার্টনার ও সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে কাজ করছি।'
ব্যাংকটি প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্ব করছে ঋণ মূল্যায়ন, ক্রেডিট স্কোরিং ও মনিটরিং উন্নত করতে। তথ্যভিত্তিক ও কাঠামোবদ্ধ এসএমই ঋণে এমটিবি জোর দিচ্ছে বলে জানান মাহবুবুর রহমান।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুর্বল হলেও এমটিবি সতর্ক অবস্থানে আছে। ব্যাংকটি এখন ঋণ দিতে ঝুঁকি নিচ্ছে না বলে জানায়। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীলতার অপেক্ষায় আছেন। আমরা শুধু ভালো করতে থাকা খাতগুলোতে ঋণ দিচ্ছি।'
বর্তমানে ব্যাংকটি ওষুধ, টেক্সটাইল, রপ্তানিমুখী শিল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। রিয়েল এস্টেট ও নির্মাণ খাতে সীমিত ঋণ রাখছে। সিইও মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমাদের দর্শন হলো দায়িত্বশীল প্রবৃদ্ধি। যথাযথ যাচাই ছাড়া দ্রুত সম্প্রসারণ ভবিষ্যতে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।'
ব্যাংক খাতে অনাদায়ী ঋণ (নন-পারফমিং লোন বা এনপিএল) বেড়ে গেলেও এমটিবি এই হার শিল্পখাতের গড়ের নিচে রাখতে পেরেছে। ২০২৪ সালের শেষে তাদের এনপিএল ছিল ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আগাম ঝুঁকি শনাক্ত করতে পারা এবং অনাদায়ী ঋণ সমস্যার সমাধান করার জন্য আমাদের অভিজ্ঞ দলও রয়েছে। আমরা প্রতি তিন মাসে স্ট্রেস টেস্ট করি এবং বড় ঋণের দিকে কড়া নজর রাখি। কয়েকজন গ্রাহকের হাতে ঋণ কেন্দ্রীভূত হতে দিই না। আমাদের ঋণসংক্রান্ত সংস্কৃতি শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্মিত।'
ঋণ পুনরুদ্ধারে ব্যাংকটি আলোচনার পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নেয়। যেসব ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব, ব্যাংকটি তাদের সহায়তা করে। তবে প্রয়োজনে কঠোর হতেও দ্বিধা করে না। সহানুভূতি ও শৃঙ্খলার মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলছে ব্যাংকটি— এমনটাই জানান সিইও। দুর্বল প্রতিষ্ঠানের তুলনায় গ্রাহকরা এমটিবিতে বেশি আমানত রাখছেন বলেও জানান তিনি।
ডিজিটাল রূপান্তর এখন এমটিবির মূল কৌশল। এ বছর তারা চালু করেছে এমটিবি নিও, নতুন প্রজন্মের ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম। মোবাইল এই অ্যাপটিতে আছে এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট, স্বয়ংক্রিয় কল সাপোর্ট ও ভবিষ্যতে ভয়েস কমান্ড সেবা চালুর পরিকল্পনা। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স ছাড়াও আমরা সম্পূর্ণ ডিজিটাল অভিজ্ঞতা দিতে চাই।'
ব্যাংকটি মূল ব্যাংকিং সফটওয়্যার ও ডেটা অ্যানালিটিকসেও বিনিয়োগ করছে। গ্রাহক অভিজ্ঞতা, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও জালিয়াতি শনাক্ত করতে তারা পূর্বাভাসভিত্তিক বিশ্লেষণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কাজ করছে। সিইও বলেন, 'ব্যাংকিং এখন শুধু শাখায় যাওয়ার বিষয় নয়, এটি এখন সহজলভ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপার। আমরা ডিজিটাল প্রজন্ম ও ঐতিহ্যবাহী উভয় গ্রাহককেই সেবা দিতে চাই।'
মাহবুবুর রহমান জানান, সুশাসন এমটিবির মূল ভিত্তি। বোর্ডের অডিট, রিস্ক ও কমপ্লায়েন্স কমিটি সক্রিয়ভাবে তদারকি করে। ব্যাংকের পরিচালকরা অভিজ্ঞ পেশাজীবী, যারা প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তকে সুশাসনের কাঠামোর মধ্য দিয়ে যেতে দেন।
দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নকেও তিনি গুরুত্ব দেন। বলেন, 'প্রযুক্তি কিছুদূর সাহায্য করে, কিন্তু ব্যাংকের আসল শক্তি তার কর্মীরা। আমরা প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও নেতৃত্ব বিকাশে বিনিয়োগ করি।' ব্যাংকটি নারী নেতৃত্ব বাড়াতেও কাজ করছে, বড় সংখ্যক নারী এখন ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন।
এমটিবি পরিবেশ, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) নীতি গ্রহণ করেছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, অফিসে কাগজবিহীন ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব চর্চা উৎসাহিত করছে।
সম্প্রতি ব্যাংকটি শুরু করেছে এমটিবি স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্কুল, যেখানে বেকিং, গ্রাফিক ডিজাইন ও ডিজিটাল মার্কেটিং-এর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর লক্ষ্য তিন বছরে ১ হাজার ২০০ তরুণকে দক্ষ করে তোলা। সিইও বলেন, 'আমরা চাই তরুণরা কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষতা অর্জন করুক।'
এছাড়া ব্যাংকটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দুর্যোগ সহায়তা খাতেও এনজিও ও সমাজসংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে। আগামী দিনে ব্যাংকের লক্ষ্য মূলধন শক্তিশালী করা, ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানো এবং শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত মুনাফা নিশ্চিত করা। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমরা সবসময় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংক না-ও হতে পারি, কিন্তু আমরা সবচেয়ে দায়িত্বশীল ব্যাংক হতে চাই।'
মাহবুবুর রহমান একটি হাইব্রিড ব্যাংকিং মডেল গড়ার স্বপ্ন দেখেন— যেখানে শারীরিক উপস্থিতি থাকবে, আবার ডিজিটাল গতিশীলতাও থাকবে। তিনি বলেন, 'আমরা এমন ব্যাংক হতে চাই, যা প্রতিটি প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকবে— আধুনিক কিন্তু নির্ভরযোগ্য।
সবশেষে তিনি বলেন, 'এমটিবি শুধু ব্যাংকিং-এর গল্প নয়, এটি প্রকৃত মূল্যবোধ না হারিয়ে সম্পর্ক গড়া ও পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলার গল্প।'


Comments