প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে, কতটা সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারবে বাংলাদেশ

প্রবীণ জনগোষ্ঠী, বিবিএস, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো,
অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ এই জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশিত জনমিতিক লভ্যাংশসহ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) নিতে পারবে কি না।

৬৫ বছরের বেশি বয়সী ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা আছে, নিম্ন মধ্যম-আয়ের বাংলাদেশ তা পূরণে প্রস্তুত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০২৩-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, গত বছর ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের নির্ভরতা অনুপাত ২০২২ সালের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

নির্ভরতা অনুপাত ‍মূলত জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর একটি পরিমাপক। এটি অর্থনৈতিকভাবে অন্যদের সহায়তার ওপর 'নির্ভরশীল' ব্যক্তিদের সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'এই ফলাফল আমাদের দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। একইসঙ্গে সরকারকে কী ধরনের নীতি ও বিনিয়োগ শুরু করতে হবে তা নিয়েও বার্তা দেয়।'

এ সমস্যা সমাধানে মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'যত দিন যাচ্ছে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে।'

তিনি প্রবীণদের সহযোগিতার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

'সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে তাদের জন্য আমাদের সহায়তা বাড়াতে হবে,' বলেন তিনি।

২০১৫ সালে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করে।

তিনি বলেন, 'আমাদের এখনই কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।'

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কৌশলের অংশ হিসেবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'পেনশন ব্যবস্থা আমাদের জন্য কার্যকর হবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম মনে করেন, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কারণে তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে।

তার মধ্যে একটি হচ্ছে, তরুণ জনগোষ্ঠী যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড দেয় তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না।

তিনি জানান, জনসংখ্যার একটি অংশের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৬০ বছর ও তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ।

এটি অবশ্য বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজনের বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন, ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি প্রবীণ সমাজে পরিণত হবে এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে জাপানের মতো প্রবীণ সমাজে পরিণত হবে।

তিনি জানান, যখন কোনো দেশের প্রবীণ নির্ভরশীলরা জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তখন তাকে প্রবীণ সমাজ বলা হয়। যদি এই হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তবে জাতিকে প্রবীণ সমাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর অংশ বাড়বে।

তার মানে এই গোষ্ঠীকে শ্রমবাজারের সঙ্গে জড়িত রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে।

তিনি বলেন, 'তাদের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের আগে থেকেই চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করতে হবে।'

প্রবীণ জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি সরকারের বাজেটের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে, কারণ বিশ্বের সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য প্রত্যাশার চেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

চলতি অর্থবছরের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাজেট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ১১ শতাংশ বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এ বরাদ্দ বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বর্তমানে প্রবীণদের জন্য মাসিক বয়স্ক ভাতা ৬০০ টাকা এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ লাখ ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক কোনো না কোনও রাষ্ট্রীয় সহায়তার অধীনে আছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে ১ কোটি ৪ লাখের বেশি হয়েছে।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ বলেন, আগামী বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠীর অনুপাত কমবে এবং প্রবীণ জনসংখ্যার অনুপাত বাড়বে।

তিনি বলেন, 'তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষম মানুষের অনুপাত কমে আসবে। এজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।'

তিনি বলেন, মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যগত জটিলতা বাড়তে থাকে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কাজ ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা একাকীত্বেও ভোগেন।

'আমাদের এমন অনেক অভিভাবক আছেন, যাদের সন্তান বিদেশে চাকরি করেন বা শহরে থাকেন। ফলে এই বৃদ্ধ বাবা-মা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। গ্রামাঞ্চলেও নিঃসঙ্গ প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে,' বলেন তিনি।

২০১৩ সালে সরকার প্রবীণদের জন্য জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে এবং একটি আইন প্রণয়ন করে, যেখানে সন্তানদের জন্য পিতামাতার দেখভালের দায়িত্ব বাধ্যতামূলক করা হয়।

তিনি বলেন, 'আমার জানামতে এ দুটির কোনোটিই বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই।'

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রবীণদের ঘর ও অন্যান্য সুবিধা দিতে বেসরকারি খাত ও এনজিওগুলোর বিভিন্ন উদ্যোগ আছে।

'এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানসম্মত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে।'

তিনি জানান, বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এটি বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ভোগের মাঝামাঝি অবস্থানে আছে।

তিনি বলেন, 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কমে গেলে নির্ভরশীলতার অনুপাত বাড়বে।'

প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন বার্ধক্য সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।

তিনি পরামর্শ দেন, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের আগে ৭০ বছরের বেশি বয়সী প্রবীণদের সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

Comments

The Daily Star  | English

Sabalenka beats Anisimova to win second straight US Open title

The Belarusian has not missed a hardcourt major final since 2022 and her latest trophy brings her Grand Slam haul to four, as she became the first woman to win back-to-back US Opens since Serena Williams claimed three straight from 2012 to 2014

3h ago