ক্ষুদ্র উদ্যোগে কমছে মূলধন ও বিক্রি, বাড়ছে ছাঁটাই

ফাইল ছবি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করে তখন এর প্রভাব পড়ে ফরিদপুরের পরিতোষ কুমার মালো বা চুয়াডাঙ্গার মো. অলি উল্লাহসহ আরও অনেকের ওপরও।

গত তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকায় পণ্যের বিক্রি কমেছে। পরিতোষ ও অলি ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত করেছেন।

যদি এটি টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট না হয় তবে তারা কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন।

হতাশারও সীমা আছে।

যদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত না কমে, তবে দেশের জিডিপিতে ৩২ শতাংশ অবদান রাখা ও শিল্পখাতে ৮৫ শতাংশ মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করা ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে—দেশে প্রায় ৭৯ লাখ ছোট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে টিকে থাকার লড়াই করছে।

অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর খরচ কমেছে। এটি এসএমই সংকটকে আরও গভীর করেছে।

ফরিদপুরের আর কে মেটালের মালিক পরিতোষের কথাই ধরা যাক। তার ওয়ার্কশপে একসময় ২৫ জন কাজ করতেন। সেখানে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়।

তিনি বলেন, 'সরকারি প্রকল্পে পণ্য দিতাম। গত ছয় মাস ধরে কাজ বন্ধ। নতুন কার্যাদেশ পাইনি।'

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তিনি ইউএসএআইডির অর্থায়নে এক প্রকল্পে ২০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি দিয়েছেন। নতুন মার্কিন প্রশাসন বিদেশি সহায়তা কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় সেই টাকা পাওয়া এখন অনিশ্চিত।

পরিতোষ জানান, মাত্র ছয়-আট মাস আগেও তার কারখানা থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় হতো। এখন তা তিন লাখ টাকায় নেমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রতি মাসে তাকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হয়।

তার কৃষিযন্ত্রের চাহিদা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ।

একদিকে, ডিলাররা কৃষিযন্ত্র কিনতে দ্বিধা করেন; অন্যদিকে, কৃষকরা নতুন যন্ত্র কিনতে হিমশিম খান। পরিতোষের প্রশ্ন, 'হাতে টাকা না থাকলে ওরা কিনবে কী করে?'

সব শ্রমিককে নিয়ে কারখানা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় পরিতোষ ১৫ জনকে ছাঁটাই করেছেন। দুঃখ করে বলেন, 'তাদের ছাঁটাই করা বেদনাদায়ক ছিল। তারা পরিবারকে খাওয়াবে কী?'

ভুট্টা মাড়াই, সরিষার তেল নিষ্কাশন মেশিনের মতো কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করেন চুয়াডাঙ্গার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক মো. অলি উল্লাহ।

পরিতোষের মতো তিনিও বলেন, 'কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কিনছে না বলে বিক্রি কমেছে।'

তিনি শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করলেও এখন ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা করছেন।

'২০২০ সালে অগ্রণী ব্যাংক থেকে যখন সুদ নিই তখন হার ছিল নয় শতাংশ। পাঁচ কোটি টাকা নিয়েছিলাম। এখন সুদের হার বেড়ে ১৭ শতাংশ হয়েছে। আমার ঋণ পরিশোধের খরচ অনেক বেড়েছে।'

অলি বলেন, 'মূলধন কমে যাচ্ছে। ঈদের পর ব্যবসা চালাতে হলে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হতে পারে।' কাজ ধরে রাখার শত চেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণের তথ্যেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সংকট উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ বছরে ১৬ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এক দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি।

এ দিকে, এসএমইগুলোর জন্য অর্থায়নের খরচ ২০২৩ সালের জুনে ছয় দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১২ দশমিক ১২ শতাংশ করা হয়। এটি ব্যবসাকে আরও চাপে ফেলে।

ঋণ নেই, আছে লড়াই

পরিতোষ ও অলির মতো 'ডিজাইন বাই রুবিনা'র স্বত্বাধিকারী রুবিনা আক্তার মুন্নির ব্যাংক ঋণ নেই।

তিনি চামড়ার ট্রাভেল ব্যাগ ও জ্যাকেট তৈরি করেন। গত তিন মাসে অনলাইন, করপোরেট ও রপ্তানি আদেশ কমেছে বলে জানান তিনি।

'ক্রেতারা বিলাসবহুল পণ্য কিনছেন না,' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'প্রবাসী ও স্থানীয় চামড়া পণ্য রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কার্যাদেশ পেয়ে যে পণ্য দিয়েছি সেই টাকা পাচ্ছি না। আর্থিক সংকটের কারণে টাকা দিতে দেরি করছেন।'

আয় কমে যাওয়ায় ৭১ কর্মীর বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তার ভাষ্য, 'এই কঠিন পরিস্থিতি শুধু আমাকে নয়, অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে সংকটে ফেলেছে।'

কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কার্যাদেশ স্থগিত করেছে।

ব্যাংক ঋণ না থাকায় স্বস্তি পেলেও প্রতিদিনের কাজ চালানো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

সোনালি আঁশে রূপালি প্রলেপ

নরসিংদীর ক্রিয়েটিভ জুট টেক্সটাইলের মালিক অজিত কুমার দাস দেশের 'সোনালি আঁশ' খ্যাত পাটের তৈরি পরিবেশবান্ধব ব্যাগের চাহিদার কারণে তার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন।

অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যখন টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন তার প্রতিষ্ঠান পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন দোকানে পণ্য সরবরাহ করছে। তার কিছু ব্যাগ পরোক্ষভাবে বিদেশে যায়।

'বেসিক ব্যাংক আমাকে সহায়তা করেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যতদিন মান বজায় রেখে আকর্ষণীয় ডিজাইনে পণ্য তৈরি করতে করব, ততদিন চাহিদা থাকবে।'

বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ১০০ জনেরও বেশি কর্মী আছে। কয়েকটি সফল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি একটি।

ঋণ বন্ধে এসএমই ফাউন্ডেশন

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও এম মাসরুর রিয়াজ পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্সের (পিএমআই) বরাত দিয়ে জানান, এসএমই খাতে মন্দা চলছে।

তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তিনি বলেন: মূল্যস্ফীতির কারণে উত্পাদন খরচ বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের চাহিদা কমেছে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী এসব চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে বলেন, 'এসএমই খাত সীমিত পুঁজিতে চলে। এটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা মেলা ও সম্মেলনের মাধ্যমে অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতার জন্যও কাজ করছি। ব্যাংক, করপোরেট ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের অগ্রগতি নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body being taken to Manik Mia Avenue for janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago

Farewell

10h ago