প্রতিযোগিতা আইন

প্রতিযোগিতা কমিশনকে তল্লাশি ও জব্দের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব

প্রতিযোগিতা আইনের প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে (বিসিসি) অফিস তল্লাশি এবং নথি, কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক তথ্য জব্দ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতদিন কর কর্তৃপক্ষের এ ধরনের আইনি সক্ষমতা ছিল।

খসড়া আইন অনুযায়ী, কমিশনের কর্মকর্তারা সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন এবং সাক্ষীর উপস্থিতিতে তল্লাসী ও জব্দ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।

খসড়া আইনে 'লিনিয়েন্সি' বা দয়া দেখানোর একটি নতুন বিধানও যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের দোষ স্বীকার করবে এবং তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করবে কমিশন তাদের শাস্তি কমাতে বা মওকুফ করতে পারবে।

এই ধারা বর্তমান প্রতিযোগিতা আইন-২০১২-তে ছিল না।

তবে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রস্তাবিত প্রতিযোগিতা আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবে। আপিল করার আগে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে।

যদি আপিলে তারা জিতে যায় তাহলে অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে, বলা হয়েছে খসড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষক প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে খসড়ায় কমিশনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান তিনি।

এদিকে প্রস্তাবিত সংশোধনীর কিছু ধারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন।

অবশ্য কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খসড়া আইনটি আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে তৈরি করা হয়েছে এবং নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করেই চূড়ান্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের আইনে গঠিত প্রতিযোগিতা কমিশন ২০১৬ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এই কমিশন বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, মূল্য কারসাজি রোধ করা ও ভোক্তাদের অনৈতিক ব্যবসা থেকে সুরক্ষা দিতে কাজ করে।

ডিজিটাল কারসাজি দমন ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন

যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অ্যালগরিদম, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ বা ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে অনলাইন বাজারে কারসাজি করে প্রস্তাবিত আইনে কমিশনকে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, তাদের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল অর্থনীতির যুগের সঙ্গে আইনে সামঞ্জস্য আনা এবং বাজারে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা।

নতুন একটি ধারা অনুযায়ী, ভোক্তার তথ্যের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ যদি প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাজারে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে, তবে সেটিকেও 'ক্ষমতার অপব্যবহার' হিসেবে গণ্য করা হবে।

খসড়া আইনে কমিশন একটি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে। এই ট্রাইব্যুনালে একজন চেয়ারপারসন থাকবেন। তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে হবে বা অন্তত ২০ বছরের বিচারিক অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

সদস্য হিসেবে সর্বাধিক দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। তাদের অর্থনীতি, আইন, ব্যবসা বা হিসাববিদ্যার ক্ষেত্রে অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকবে। প্রতিটি খাত থেকে সর্বোচ্চ একজন করে সদস্য রাখা যাবে।

কমিশনের শাস্তির আদেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে আপিল করতে হবে। জরিমানার ক্ষেত্রে আপিল করতে হলে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। তবে শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

ন্যায্য শুনানি ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে খসড়ায় স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা অনেক উন্নত দেশের ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোকে স্বাগত

ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা এই পরিবর্তনগুলোকে সতর্কভাবে স্বাগত জানিয়েছেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেছেন, এই পরিবর্তনগুলো স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার, পণ্য ও সেবার সংযুক্তি, অ্যালগরিদমের কারসাজি ও লিনিয়েন্সি বিষয়গুলো ঠিক করা।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, বাজার কাঠামো, প্রতিযোগিতার মাত্রা ও ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় প্রমাণের ভিত্তিতে বাজারে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, 'প্রস্তাবিত তল্লাশির ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে হয়রানি ও ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে বাধা তৈরি হতে পারে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেছেন, এই সংশোধনীগুলো একটি বড় পদক্ষেপ, যা প্রতিযোগিতা আইনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করছে।

তিনি বলেন, 'লিনিয়েন্সি, যৌথ প্রভাবশালী ক্ষমতা ও ডিজিটাল বাজারে অপব্যবহারসহ নতুন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাজারের পরিবর্তন বোঝা যায়।'

তিনি যোগ করেন, আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ও যথাযথ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে, যা বর্তমান আইনে অনুপস্থিত।

তল্লাশি ও জব্দ করার ক্ষমতা সম্প্রসারণ নিয়ে তিনি বলেন, 'যদি দায়িত্বশীলভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে আইনটির কার্যকারিতা বাড়বে।'

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এই সংশোধনীগুলো কমিশনের স্বাধীন ক্ষমতা বাড়িয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত তদারকি বা জবাবদিহিতার বিষয়টি সেভাবে নেই।

তিনি বলেন, 'বিস্তৃত সংজ্ঞা, সীমাহীন তল্লাশি ক্ষমতা ও অস্পষ্ট লিনিয়েন্সি ব্যবস্থা ইচ্ছামতো আইন প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারে।'

তার মতে, 'এই সংশোধনীগুলো কমিশনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে না। এছাড়া অতিরিক্ত ক্ষমতা বৈধ ব্যবসায়িক সহযোগিতা ও উদ্ভাবনকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।'

অপরাধের জন্য কারাদণ্ড নেই

প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, যারা বলছেন সংশোধনীগুলো বিপজ্জনকভাবে কমিশনের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তারা আসলে ভুল ভাবছেন।

তার ভাষ্য, 'বাংলাদেশের ব্যবস্থা এখনো যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক শিথিল। প্রস্তাবিত আইনে প্রতিযোগিতা-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য কোনো কারাদণ্ডের বিধান নেই।'

'যদিও খসড়াটি কঠোর মনে হতে পারে, তবে বাস্তব প্রভাব নির্ভর করবে প্রয়োগের ওপর,' যোগ করেন তিনি।

কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গঠনের পর থেকে এখন ৩৪টি মামলা শুনানির পর্যায়ে আছে, এবং ৫৪টি রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

বিসিসি চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীর আগে ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিযোগিতা আইনগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, 'মন্ত্রণালয় পর্যায়ের পরামর্শ শেষে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে।'

Comments