এলডিসি উত্তরণ ঘনিয়ে এলেও এখনো অপেক্ষায় বাণিজ্য চুক্তি
২০২৫ শেষের পথে, এমন সময়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়সীমার দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ।
২০২৬ সালের নভেম্বরেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ করবে। আর এই সময়সীমার বাকি আছে এক বছরেরও কম। তবে তৈরি পোশাক রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এই উত্তরণ কেবল প্রতীকী কোনো অর্জন নয়। বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্বের বড় বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারানোর বাস্তব ঝুঁকি।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা জোরদার করেছে। এ ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস), যা মূলত একটি নীতিগত রূপরেখা এবং যার লক্ষ্য হলো এলডিসি উত্তরণের ধাক্কা কমিয়ে আনা।
তবে প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা চললেও অধিকাংশ চুক্তিই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে গেছে। হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া খুব কম চুক্তিই বাস্তবায়নের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে রপ্তানিকারকেরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
অবশ্য কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। যেমন গতকালই একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইপিএ) আলোচনা শেষ হয়েছে। চুক্তিটি স্বাক্ষর ও অনুমোদনের পর কার্যকর হলে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের ৭ হাজার ৩৭৯টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, যার মধ্যে তৈরি পোশাকও রয়েছে। অন্যদিকে, জাপানের ১ হাজার ৩৯টি পণ্যে একই সুবিধা দেবে বাংলাদেশ।
এই চুক্তির আওতায় সেবাখাতও আছে। বাংলাদেশ ৯৭টি সেবা খাত ও জাপান ১২০টি খাত খুলবে, যা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করবে। এখন চুক্তিটি আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর এবং জাপানের পার্লামেন্টে অনুমোদনের দিকে এগোবে, এরপরই এটি কার্যকর হবে।
দক্ষিণ কোরিয়াকেও তুলনামূলকভাবে আরেকটি আশাব্যঞ্জক দিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের মতে, সিউলের সঙ্গে পৃথক একটি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) নিয়ে আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। কর্তৃপক্ষ আশা করছে, খুব শিগগিরই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি), আসিয়ানভুক্ত দেশ, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ একাধিক অংশীদারের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
তবে একসঙ্গে এতগুলো আলোচনা চললেও অগ্রগতি তেমন দ্রুত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার তারিখের জন্য এখনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঢাকাকে।
এই ধীরগতির জন্য অর্থনীতিবিদরা দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্কহার ২৮ শতাংশেরও বেশি। এই হার মালয়েশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি, কারণ সেখানে এই হার প্রায় ৫ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার বলেন, 'বেশি শুল্ক ও সুরক্ষা নীতির কারণে অনেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী হয় না।'
তিনি মনে করেন, শুল্কহার কমালে বাণিজ্য আলোচনা দ্রুত এগোতে পারে। তবে এতে রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়বে। কারণ আমদানি শুল্ক এখনো সরকারের অন্যতম প্রধান রাজস্ব উৎস। ফলে বাণিজ্য নীতিতে সংস্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই সংবেদনশীল।
তার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতিও একটি বড় বাধা।
পাশাপাশি বাংলাদেশে পর্যাপ্ত দক্ষ আলোচক নেই। আর গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি-আমদানি নীতিসংক্রান্ত নথিপত্র সব সময় ইংরেজিতে পাওয়া যায় না। এসব কারণে বিদেশি অংশীদারদের জন্য আলোচনা ও যোগাযোগের প্রক্রিয়া সীমিত হয়ে পড়ে।
অন্যদিক ব্যবসায়ী মহল এক ধরনের উদ্বেগ নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
উচ্চ সুদের হার, অনিয়মিত জ্বালানি সরবরাহ, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে এলডিসি উত্তরণের সময়টি ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, 'বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করতে সময় লাগে, তাই আমরা সরকারকে এলডিসি উত্তরণ কিছুটা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলাম।'
'ব্যবসায়ীরা যেসব আর্থিক চাপের মধ্যে আছে, তাতে এখন এলডিসি থেকে উত্তরণ করার সময়টা ঠিক নয়,' বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
শিল্পখাতের নেতারা বারবার ছয় বছরের জন্য এলডিসি উত্তরণ স্থগিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের যুক্তি হলো, বড় ধরনের কোনো বাণিজ্য চুক্তি এখনো হয়নি এবং সরকারি ও বেসরকারি দুই পর্যায়েই প্রস্তুতি সীমিত।
দেশের রপ্তানি খাতের মেরুদণ্ড তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ব্যবসায়ীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলেও তাদের কথা অনেক সময় শোনা হয় না।
তিনি বলেন, 'দেশ আগামী বছর এলডিসি থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছে, অথচ প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের ধরে রাখতে এখনো কোনো বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়নি, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে রপ্তানি খাত ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানি প্রণোদনা ইতোমধ্যে কমানো হয়েছে। সরকার প্রতিযোগিতা বাড়াতে যেসব সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে, সেগুলোর প্রভাব এলডিসি সুবিধা হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, টেক্সটাইল শিল্প ইতোমধ্যে সংকটের মধ্যে আছে।
তিনি জানান, 'ভারত থেকে সস্তা সুতা আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত এক বছরে এর পরিমাণ ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে গ্যাস সংকটে জর্জরিত দেশীয় স্পিনিং মিলগুলোর ওপর চাপ আরও বেড়েছে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, পোশাক খাতে কোনো ধরনের ধাক্কা এলে দেশের টেক্সটাইল শিল্পে বিনিয়োগ করা প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কিছু নীতিনির্ধারক সম্ভাবনাও দেখছেন।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক জাপানের সঙ্গে করা ইপিএ চুক্তিকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশ, হংকং, চিলি ও শ্রীলঙ্কার সদস্যপদ যোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য আরসিইপি প্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়েছে।
অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য জোটে প্রবেশের সুযোগ পাবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চলমান আলোচনা সফল হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যার মাধ্যমে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার বজায় থাকবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৭৩ শতাংশ রপ্তানি ৩৮টি দেশে এলডিসি সংশ্লিষ্ট শুল্কমুক্ত সুবিধার ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই সুবিধা হারালে দেশের রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে আনুমানিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
বছর শেষে এসে বাণিজ্য আলোচনার সামগ্রিক চিত্রও এখন স্পষ্ট। তবে বাংলাদেশ বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছে, কৌশল নির্ধারণ করেছে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রমও করেছে। কিন্তু আলোচনা থেকে চুক্তির বাস্তব প্রয়োগে পৌঁছানোর দীর্ঘ পথটাই এখন দেশের বাণিজ্য অঙ্গনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Comments