নচিকেতা ঘোষ: সুরের স্বরলিপিতে লেখা অমর এক নাম

প্রচণ্ড শীতের রাত, নচিকেতা ঘোষ তখন কিশোর। জুদ্দন বাইয়ের এক ধ্রুপদ সংগীতের আসর দেখে গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছেন। সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে নচিকেতা ঘোষ, বাড়িতে গান-বাজনাকে ভালো চোখে দেখা হয় না।
বাবা বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. সনৎকুমার ঘোষ, বাড়িতে দিদিমার কড়া শাসন। বাড়ির ইচ্ছা নচিকেতাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ডাক্তারই হতে হবে।
অবশেষে সেটাও হলো। নচিকেতা ঘোষ মেডিকেল পড়লেন, হলেন ডা. নচিকেতা ঘোষ। কিন্তু ততদিনে সংগীতের নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। ঠিক করে ফেলেছেন, গানই করবেন।
লেখাপড়া যখন শেষদিকে, তখনই প্রথম সুযোগ মিলে গেল। বন্ধু গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় কিংবদন্তী সংগীত সাধক সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে তিনি রেকর্ড করলেন 'যে প্রেম নীরবে কাঁদে।' সালটা ১৯৪৯। গানটি মোটামুটি জনপ্রিয়তাও পেল। নচিকেতা ঘোষের গায়কীতে খুশি হয়েছিলন সুধীরলাল।

লেখাপড়া শেষ হলো, কিন্তু ডাক্তারিতে মন বসল না নচিকেতার। মাথায় তখন শুধু গান, চেষ্টা করতে থাকলেন গানকেই জীবিকার মাধ্যম করার।
সুযোগ এসে গেল ১৯৫৩ সালে। 'বৌদির বোন' সিনেমায় সুরারোপ করলেন। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ল। ১৯৫৬ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য সুর করলেন 'অনেক দূরের ওই যে আকাশ নীল হলো।' গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। এ বছরই অগ্রদূতের 'ত্রিযামা' সিনেমায় সুর দিলেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটির এই সিনেমা ও এর গান, সবই খুব জনপ্রিয় হলো। এর ভেতরই 'বাংলার সায়গল'—খ্যাত সুপারস্টার রবীন মজুমদারের অসুস্থতায় তার পাশে থেকেছেন, চিকিৎসা করেছেন। তার পড়ন্ত ক্যারিয়ারের সময়ে তাকে দিয়ে গাইয়েছেন 'এই তো এলাম শঙ্খ নদীর তীরে।'
গানগুলোর ধারাবাহিক সাফল্যের পরহ নচিকেতা ঘোষকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৭ সালে 'পৃথিবী আমারে চায়' সিনেমায় গীতা দত্তের গাওয়া 'নিশি রাত বাঁকা চাদ আকাশে', ১৯৫৮ সালের 'ইন্দ্রাণী' সিনেমায় হেমন্তের কণ্ঠে 'নীড় ছোট ক্ষতি নেই', 'সূর্য ডোবার পালা' তুমুল জনপ্রিয়।
হেমন্তেরই কণ্ঠে 'বন্ধু' সিনেমার 'মৌ বনে আজ মৌ জমেছে'-গানটিও অবিস্মরণীয়। সে সময়ই সলিল চৌধুরীর কথায় 'আঁধারে লেখে গান জোনাকি' গানটির সুর দেন তিনি। গানটি গেয়েছিলেন সবিতা চৌধুরী।
বাংলা সিনেমায় প্রথম হিন্দি গানও করেন নচিকেতা ঘোষ। 'ইন্দ্রাণী' সিনেমায় মোহাম্মদ রফিকে দিয়ে গাওয়ান 'সাভি কুছ লুটাকার।' রফি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, রেকর্ডের জন্য টাকা নেননি। বলেছিলেন, 'ইতনা মিঠা তান!'
এরপর নচিকেতা ঘোষ মনস্থির করলেন তিনি বোম্বে যাবেন। সর্বভারতীয় সুরকার হয়ে উঠবেন। তিনি ১৯৬০ সালে বোম্বে গেলেন। পরিবার রইলো কোলকাতাতেই।

বোম্বেতে তিনি অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের সাথে থাকতেন। কিন্তু, সেখানে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। সবসময় প্রযোজকদের চাহিদামতো গান তৈরি করতে চাইতেন না তিনি। তার কাছে ব্যবসায়িক স্বার্থের চেয়ে বড় বিষয় ছিলো সংগীতের মান। শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন গান কার গলায় মানাবে, এটাই ছিল বিচার্য। তাই বোম্বেতে কাজ তেমন মিলছিল না। তারপরও হাল ছাড়েননি। কিন্তু একপর্যায়ে আর সেখানকার সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। ১৯৬৭ সালে তিনি ফিরে এলেন কোলকাতায়।
কোলকাতা কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করেই ছিল। হাতে আবার আসতে লাগলো একের পর এক কাজ। 'শেষ থেকে শুরু' (১৯৬৮), 'চিরদিনের' (১৯৬৯), 'নিশিপদ্ম (১৯৭০), 'বিলম্বিত লয়' (১৯৭০) সিনেমার গানে সুর দিলেন।
'চিরদিনের' সিনেমাটির সব গানই তুমুল জনপ্রিয় হয়। 'আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও' (মান্না দে ও সন্ধ্যা), 'লাল নীল সবুজেরই মেলা বসেছে' (মান্না দে) — খুবই জনপ্রিয়তা পায়।
'নিশিপদ্ম' সিনেমায় মান্না দে'র কণ্ঠে 'না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না' কিংবা 'বিলম্বিত লয়' সিনেমায় আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে 'এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার' প্রমাণ করে দেয়, নচিকেতার ঘোষের মেলোডির শক্তি কতটা!
আবারও ক্যারিয়ারের শীর্ষে নচিকেতা ঘোষ, হাতে প্রচুর কাজ। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় মান্না দে'র কণ্ঠে 'যদি কাগজে লেখো নাম', 'ক ফোঁটা চোখের জল' গানগুলো পেল তুমুল জনপ্রিয়তা। মাঝে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু কারণে মনোমালিন্য ও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল নচিকেতার। তবে ১৯৭১ এ 'স্ত্রী' সিনেমার 'খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার' করার পর তিনি হেমন্তকে দিয়ে আবারও গান করান।
১৯৭২ সালে তার সুরে হেমন্তের কণ্ঠে 'যদি জানতে চাও তুমি' কিংবা ১৯৭৪ সালে 'এক গোছা রজনীগন্ধা' ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। হেমন্তের আরেকটি আইকনিক গান 'আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে' গানটিও নচিকেতা ঘোষের সুর। এছাড়াও আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা', তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চলো রীনা, ক্যাসুরিনা', সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা', মান্না দে'র 'আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে', দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ঝাউবনটাকে পেরিয়ে', মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের 'তোমায় আমায় প্রথম দেখা', নির্মলা মিশ্রর 'এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না', আরতি মুখোপাধ্যায়ের 'এই মোম জোছনায়, 'জলে নেবো না' গানের সুর করেন তিনি।
নচিকেতা ঘোষের সমসাময়িক সুরকারদের ভেতর সলিল চৌধুরী কিংবা সুধীন দাশগুপ্ত সঙ্গীতে পশ্চিমি ধাঁচের সুরের অনুসারী হলেও নচিকেতা ঘোষ প্রাচ্যের সুরকেই তার প্রধান আশ্রয় করেছেন। এর সঙ্গে দরকারমতো নিয়েছেন পশ্চিমের সুর, তবে সেটা তার গানে কখনোই প্রধান হয়ে ওঠেনি।
অনুপম ঘটকের (১৯১১-১৯৫৬) হাত দিয়ে বাংলা গানে ডিমিনিশিং কর্ডের যে ব্যবহার শুরু হয়, তা নচিকেতা ঘোষই পরে ধরে রেখেছিলেন।
তার রিদমের জ্ঞানও ছিলো তার প্রখর। 'ফরিয়াদ' সিনেমার 'আজ দুজনে মন্দ হলে' কিংবা 'এ ছুরি জানে ভানুমতীর খেল' গানগুলোর ক্যাবারে মেজাজ তৈরিতেও তিনি অনন্য। আবার এই গানগুলোর শিল্পী আশা ভোঁসলের সঙ্গে এর আগে করেছেন ফোকনির্ভর 'থুইলাম রে মন পদ্মপাতায়' কিংবা 'মনেরও নাম মধুমতী।'
সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) সিনেমার 'কাহারবা নয় দাদরা বাজাও' কিংবা নন-ফিল্ম 'বনে নয় মনে মোর' (শিল্পী মানবেন্দ্র) প্রমাণ করে তার রিদমজ্ঞান ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞান কতটা প্রখর ছিল! এক্ষেত্রে তবলাবাদক রাধাকান্ত নন্দীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।
গানে নাটকীয়তাও তৈরি করতে পারতেন খুব ভালো। তার সুরে হেমন্তের গাওয়া 'তার আর পর নেই' গানে গীতিকার মুকুল দত্রের স্ত্রী অভিনেত্রী চাঁদ উসমানীর কণ্ঠে বলা 'তারপর' কথাটি গানটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
নচিকেতা ঘোষ সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই তার সুরে মিউজিকের 'টোটাল অ্যাকোম্পানিমেন্ট' এর ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিল্পী যখন কোনো গান করছেন, তখন তার সুর ও বাদ্যযন্ত্র গানের কথার সঙ্গে হুবহু অনুরণন তুলে তুলে নদীর মতো বয়ে যেত। এর ফলে বাংলা গানের কম্পোজিশন অনেক এগিয়ে যায়, মেলোডি আরও সংহত হয়, গানগুলো সত্যিকারার্থেই আধুনিক হয়ে ওঠে।
নচিকেতা ঘোষ তখন খ্যাতির শীর্ষে। এর মাঝে এলো সেই দিনটি। ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর। আশ্বিনের শেষভাগ তখন। প্রচণ্ড বৃষ্টি ঝরা সেই দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন নচিকেতা ঘোষ। বাংলা গানের মুকুটহীন রাজা চলে গিয়েছিলেন আজ থেকে ৪৯ বছর আগের এইদিনে। কিন্তু থেকে গেছে তার গান। এখনো যা রয়ে গেছে শ্রোতাদের হৃদয়ে। বাংলা সঙ্গীতের আকাশে নক্ষত্র হয়ে আজো জ্বলজ্বল করছেন নচিকেতা ঘোষ। তার গানের মতোই-' আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো/ আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে/ তবু আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে...'
Comments