দূর থেকে দূরে চিরদিন রবেন সেলিম হায়দার

দূর থেকে দূরে চিরদিন রবে সেলিম হায়দার
সেলিম হায়দার। ছবি: সংগৃহীত

সেলিম হায়দার—নামটির সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নন। তবে বাংলা রক বা ব্যান্ড জগতের খোঁজ যারা রাখেন, তাদের কাছে নামটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭৪ সালের কথা, কৈশোর পেরিয়ে সদ্য তারুণ্যের বারান্দায় পা রাখা সেলিম হায়দার গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন শেখ ইসতিয়াকের গড়া ব্যান্ডদল 'সন্ন্যাসী'-তে। কিছুদিন পর হামিন-শাফিন আহমেদদের সঙ্গে বাজাতে শুরু করেন। তখনো 'মাইলস' গঠিত হয়নি। মাইলস গঠন হলে অবশ্য সেখানে যোগ দেননি সেলিম।

১৯৭৮ সালে গঠিত 'ফিডব্যাক' ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন সেলিম হায়দার। ছিলেন ফিডব্যাকের সেল্ফ টাইটেলড 'ফিডব্যাক' (১৯৮৫) ও 'উল্লাস' (১৯৮৭) অ্যালবামের লিড গিটারিস্ট।

'ফিডব্যাক' (১৯৮৫) অ্যালবামে 'ওই দূর থেকে দূরে' ও 'এইদিন চিরদিন রবে' গানগুলোর সুর তার। 'ওই দূর থেকে দূরে' গানটিতে তিনি লিড গিটারের শুরুতে নোট-বাই-নোট বাজিয়ে (আর্পেজ্জিওটেড কর্ড) এক ধরনের নরম অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি করেছেন। তার পর মাঝে মাঝে 'সফট স্ট্রামিং' যুক্ত করেছেন, যা গানটিকে রিদমিক ও হারমোনিক ডেপথ দিয়েছে। এরকম গিটার প্লেয়িং সে সময়ের বাংলা ব্যান্ড সংগীতে অনন্য।

একই অ্যালবামে 'ঝাউবনে' গানে তিনি চমৎকার মেলো-রক ধরনের আবহ তৈরি করেছেন গিটারে৷ ভোকাল জাকিউর রহমান রোমেলের ভোকালের সঙ্গে তার গিটার মিশে অনবদ্য এক মেলোডি তৈরি করেছে।

দূর থেকে দূরে চিরদিন রবে সেলিম হায়দার
ছবি: সংগৃহীত

'উল্লাস' (১৯৮৭) অ্যালবামের বিখ্যাত গান 'মৌসুমী'-তে সেলিম হায়দারের দক্ষ গিটার বাজানোর প্রমাণ মেলে। গানটিতে তিনি মেলোডি ও রিদমের ভেতর দুর্দান্ত ভারসাম্য রাখেন, যা ভোকাল মাকসুদের গলাকে ছাপিয়ে যায়নি৷ 'উদাসী' গানটিতেও আরেকটু দ্রুত গতিতে একই ধাঁচের গিটার বাজানো শোনা যায়।

ফিডব্যাক যখন সাফল্যের চূড়ায়, তখনই ব্যান্ড ছাড়েন সেলিম। সিনেমার প্লেব্যাকে বাজানোর কারণে ব্যান্ডে আর সময় দিতে পারছিলেন না।

লিড গিটারের পাশপাশি রিদম গিটার, বেজ, কি-বোর্ড বাজানোতেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন সেলিম হায়দার। চলচ্চিত্রে সত্য সাহা, আলাউদ্দীন আলী, আলম খান, শেখ সাদী খান, আবু তাহেরের মতো সুরকারদের সঙ্গে বাজিয়েছেন তিনি।

রুনা লায়লার অনেক গানে বাজিয়েছেন সেলিম। আলাউদ্দীন আলীর সুরে 'শেষ কোরো না শুরুতে খেলা' গানেও বাজিয়েছেন তিনি।

আলম খানের সুরারোপিত 'তুমি যেখানে আমি সেখানে', 'বুকে আছে মন, মনে আছে আশা' গানগুলোতেও বাজিয়েছেন তিনি।

সেলিম আবার ব্যান্ড মিউজিকে ফিরে আসেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি। মাকসুদ ও সেকান্দার খোকা ১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে 'মাকসুদ ও ঢাকা' গঠন করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সেলিম।

এই ব্যান্ডের 'প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ' (১৯৯৭) এবং 'ওগো ভালোবাসা' (১৯৯৯) অ্যালবামে বাজিয়েছিলেন তিনি।

'প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ' অ্যালবামের 'গীতিমিছিল' (গণতন্ত্র) ও 'পরওয়ারদেগার' গানগুলোর সংগীত করেন সেলিম হায়দার। গানগুলোর গিটারে তিনি নিয়ে আসেন উদাত্ত গণসংগীতের স্বাদ। আবার, এই অ্যালবামেই এস এম খালেদের সুরে ও আশিকউজ্জামান টুলুর সঙ্গীতে 'জেগে থেকো সারারাত' গানে অন্যরকম সজীবতা এনেছেন। এই গানে গিটার‑টোন পুরোপুরি 'হার্ড রক' বা হেভি ডিস্টর্টেড নয়—বরং সফট‑ইলেকট্রিক, খানিকটা রিচ, একইসঙ্গে ক্লিন।

দূর থেকে দূরে চিরদিন রবে সেলিম হায়দার
ছবি: সংগৃহীত

একই অ্যালবামে গৌতম ঘোষের সুর-সংগীতে 'বাংলাদেশ-৯৫' গানে দুর্দান্ত দক্ষতায় ব্যতিক্রমী গিটার বাজিয়েছেন সেলিম। প্রথাগত মেজর-মাইনর রিদম সাইক্লিক কর্ড প্রোগ্রেশন নয়—একটু জ্যাজ—সিম্পল রক মুড মেশানো, যেখানে সপ্তম বা 'সেভেন্থ কর্ড' রয়েছে, যা একইসঙ্গে স্নিগ্ধ, চঞ্চল অথচ এক ধরনের বিষণ্ণ মেথডিক অনুভূতি দেয়।

'ওগো ভালোবাসা' (১৯৯৯) বাংলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ রক-জ্যাজ ফিউশন অ্যালবাম। এই অ্যালবামে প্রিন্স মাহমুদের সুরে অল্টারনেটিভ রক-জ্যাজ ফিউশন 'একদিন কাঁদবে' গানে হালকা ওভারড্রাইভ গিটার বাজিয়েছেন সেলিম। তবে তা মাকসুদের বোল্ড ভোকালকে একটুও ঢেকে দেয়নি, বরং প্রয়োজনীয় সঙ্গত দিয়েছে।

অ্যালবামটির টাইটেল গান 'ওগো ভালোবাসা' জ্যাজ-রক ইন্দো-ক্ল্যাসিকাল ফিউশন। এখানে সেলিম হারমনিক মাইনর স্কেল ও মাইক্রোটোনাল বেন্ড ব্যবহার করে অসাধারণভাবে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মিউজিককে একসূত্রে বাঁধতে চমৎকার ভূমিকা রেখেছেন।

আবার, ব্লুজ-ফাঙ্ক ফিউশন 'অভিশাপের পালা'-য় সিনকোপেশন ও শর্ট স্ট্যাকাটো নোটের অনবদ্য প্রয়োগ করেছেন সেলিম। এছাড়া, হালকা মিউটেড 'গোস্ট নোটস' এর প্রয়োগ করে তিনি এই গানে 'গ্রুভ ফিল' আনতে পেরেছেন অত্যন্ত সার্থকভাবে।

তবে এই অ্যালবামের কাজ সম্পন্ন হলে সেলিম 'মাকসুদ ও ঢাকা' ব্যান্ড ছেড়ে দেন। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো ব্যান্ডের সঙ্গে বাজাননি। তবে থেমে যায়নি তার বাজানো।

এরপর 'উল্লাস' ও 'সেলিম হায়দার অ্যান্ড ফ্রেন্ডস' নামের দুটো ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি৷ কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার সঙ্গেও দেশে-বিদেশে অসংখ্য আয়োজনে গিটার বাজিয়েছেন সেলিম হায়দার।

গত কয়েক বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন তিনি। কিন্তু, গিটার প্র্যাকটিস ও বাজানো কখনোই ছাড়েননি।

অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষান্ত হয়েছে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই। বিদায়ের আগে সেলিম হায়দার বাংলাদেশের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে শুধু নয়, বাংলা সংগীত জগতকে যা দিয়ে গেছেন, তা মহাকালের তরীতে কালজয়ী হয়ে বেঁচে থাকবে দীর্ঘযুগ৷

Comments

The Daily Star  | English

‘India stayed silent for 15 years, now offers advice on election’

Foreign Adviser Touhid says India's advice on Bangladesh’s election not acceptable

30m ago