বাচ্চু ভাই বললেন ‘লেটস মেক অ্যা সং ব্যাংক’

আইয়ুব বাচ্চু ও বাপ্পী খান। ছবি: বাপ্পী খানের সৌজন্যে

'স্মৃতি শুধু জানে...কাকে রাখবে মনে...কাকে ঠেলবে দূরে...

তুচ্ছ জিনিস মনে থাকে...ভুলে যায় অনেক কিছু...স্মৃতির খেলা বড় নিঠুর...'

প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ও তার ব্যান্ড এলআরবির জন্য 'স্মৃতি' শিরোনামের এই গানটির মতো অসংখ্য গান লিখেছেন গীতিকার বাপ্পী খান। দুজনের মিথস্ক্রিয়াও ছিল দারুণ।

সময়টা ১৯৮৮ সাল। 'রক্তগোলাপ'র পর আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় সলো অ্যালবাম 'ময়না' প্রকাশ পায়। এর কয়েকদিন পর বেইলি রোডে গাইড হাউস অডিটোরিয়ামে সোলসের শো দেখতে যান বাপ্পী। কনসার্ট শেষে তার মনে হলো বাচ্চু ভাই 'ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়' গানটি না গেয়েই নেমে যাচ্ছেন। প্রিয় গায়কের কাছে আবদার করলেন গানটি শোনানোর জন্য।

প্রিয় শিল্পী গিটার গুছিয়ে ফেললেও, ফেরালেন না এইচএসসিপড়ুয়া ভক্ত বাপ্পীকে। পার্থ বড়ুয়াকে বললেন কি-বোর্ডে গানটা ধরতে, শুনিয়ে দিলেন দুই লাইন।

ওই সময় নিজেও টুকটাক গান-ব্যান্ড করতেন বাপ্পী খান। আশিকুজ্জামান টুলুর সংগীতে সলো অ্যালবামের কাজ শুরু করেন 'সারগাম' স্টুডিওতে। সেখানে আবার দেখা বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর থেকে ৩০ বছরের পথচলা।

বাংলাদেশের রক মিউজিকের আইকন আইয়ুব বাচ্চুর ৬৩তম জন্মদিন আজ ১৬ আগস্ট (শুক্রবার)। তার সঙ্গে দীর্ঘ পথচলার স্মৃতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন গীতিকার বাপ্পী খান।

আইয়ুব বাচ্চু ও বাপ্পী খান। ছবি: গীতিকারের সৌজন্যে

'সারগাম' থেকেই আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগের শুরু। আরেক কিংবদন্তি জেমসের কাছ থেকে আইয়ুব বাচ্চু জানতে পারেন যে, বাপ্পী গান লেখেন। জেমসের সুরে 'ম্যানিলা পেনফ্রেন্ড' গানটি বাপ্পীর লেখা।

ডেইলি স্টারকে বাপ্পী বলেন, 'এরপর বাচ্চু ভাই আমাকে ডাকলেন। বললেন, এলআরবির গান রেকর্ড চলছে, তুই গান দে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, গান তো নাই। বাচ্চু ভাই বললেন, কবিতা আছে? আমি বললাম, আছে কিছু। বাচ্চু ভাই বললেন, কাল নিয়ে আয়।'

'আমার সলো অ্যালবামে নিজের লেখা আটটি গান ছিল, অতি আবেগে লেখা। কিন্তু বাচ্চু ভাইকে গান দিতে হবে, কীভাবে সম্ভব। আমার দুটো কবিতার খাতা ছিল। একটা রোমান্টিক, আর অন্যটা কিছুটা বাস্তবধর্মী কবিতার। কবিতার খাতা নিয়ে পরের দিন বিকেলে সারগাম যাই। বাচ্চু ভাইকে না পেয়ে ফারুক বা ফরিদের কাছে রেখে আসি।'

'অনেক রাতে বাচ্চু ভাইয়ের ফোন। বললেন, এটা তুই কী করলি? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ভাবলাম আমার লেখা কি এতই আজব হয়েছে যে, বাচ্চু ভাই পছন্দ করেননি। হেসে বললেন, কাল ছয়টায় সারগাম আয়।'

বাপ্পী খান বলেন, 'আবোল তাবোল অনেক কথা ভাবতে ভাবতে পরদিন সারগাম গেলাম। বাচ্চু ভাই আমার মাথায় আলতো করে হাত দিলেন। এলআরবির স্বপন ভাই, জয় ভাই আর টুটুল অন্যরকম করে তাকাচ্ছিলেন। এলআরবির স্টুডিও সেশনে ঢোকার সৌভাগ্য হলো। দেখলাম "পেনশন" রেকর্ড হয়ে গেছে।'

'অফিসের দ্বারে দ্বারে দিন প্রতিদিন...মেলে নাকো পেনশন চলে যায় দিন...'

'আমার কবিতা যে এভাবে গান হতে পারে আমি কখনো ভাবিনি। যাক, সেই থেকে শুরু। ১৯৯২ সালে এলআরবি-২ নামের ওই অ্যালবামে আরও দুটি গান আমার ছিল—জীবনের মানে ও এক কাপ চা।'

এবি কিচেনে বাপ্পী খান। ছবি: গীতিকারের সৌজন্যে

'এরপর বাচ্চু ভাই আমার সঙ্গে বসলেন। বললেন, "বাপ্পী লেটস মেক অ্যা সং ব্যাংক। আমরা গান বানায় যাব। আমি টিউন করব তুই লিখবি, তুই লিখবি আমি টিউন করব। গান লিখে যাবি। যখন যেই মুড থাকবে, সেই মুডের গান লিখবি। যখন যেটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হবে রিলিজ দেবো"। এরপরের দিনগুলো কেমন করে কেটেছে বোঝাতে পারব না। ১৯৯২, ৯৩, ৯৪—এই তিন বছর আমি আর বাচ্চু ভাই প্রায় প্রতিদিনই গান নিয়ে বসেছি। আমাদের "সং ব্যাংক" করেছি। কে গাবে, কোন প্রোডাকশন করবে, এসব না ভেবেই আমরা গান জমাতাম। এই তিন বছরেই আমরা দুজনে প্রায় অর্ধশত গান বেঁধেছিলাম,' বলেন গীতিকার বাপ্পী।

আইয়ুব বাচ্চুকে যেমন সম্মান করতেন, তেমন গঠনমূলক সমালোচনাও করতেন বাপ্পী খান। সমবয়সী বন্ধুর মতো মিশতেন দুজনে। বাপ্পী বলেন, 'কোনো নতুন গান ভালো লাগলে আমি বলতাম, "থ্যাংক ইউ আইয়ুব"। বস বাচ্চাদের মতো খুশি হতেন। ভয়েস দেওয়ার সময় আমাকে প্যানেলে বসাতেন, যেন উচ্চারণ বা অন্য কোনো সমস্যা হলে আমি বলি। এমন অনেক গান আছে, আমার অনুপস্থিতিতে ওকে হওয়ার পরও, আমি পরে যখন কোনো সমস্যা পেয়েছি, বাচ্চু ভাই হাসি মুখে আবার রেকর্ড করেছেন।'

'এরপর বাচ্চু ভাই সলো অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। আমার লেখা ছয়টা গানের টিউন হয়ে গেল। তখনো এবি কিচেন চালু হয়নি। সারগামে একদিন গিয়ে দেখি আবিদুর রেজা জুয়েল ভাই (সদ্য প্রয়াত) বসা, সঙ্গে বাচ্চু ভাই। বস আমাকে বললেন, "জুয়েলের জন্য সাত দিনের মধ্যে সঙ্গীতায় গান দিতে হবে। এক কাজ করি তোর যে ছয়টা গান করেছি, জুয়েলকে দিয়ে দেই। আর আমার করা আরও ছয়টা দিয়ে দেই"। আমি আর কী বলব। বললাম দিয়ে দেন যদি আপনি চান। আসলে উনি যখন যে কাজটা করতেন, সেটাই উনার কাছে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্য কারও জন্য গান করছেন বলে যে হেলাফেলা করবে, ভালো গান রেখে খারাপটা দেবে, এমন কখনো দেখিনি,' বলেন বাপ্পী।

আইয়ুব বাচ্চু ও বাপ্পী খান। ছবি: গীতিকারের সৌজন্যে

বাপ্পী খানের লেখা শতাধিক গানের সুর করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। এরমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক এলআরবির জন্য লেখা। এমন গানের তালিকায় আছে—এখন অনেক রাত, গতকাল রাতে, সুখ, পেনশন, এক কাপ চা, যত বেশি আমি, হাসপাতালে, লোকজন কমে গেছে, স্মৃতি, সাড়ে তিন হাত মাটির মতো জনপ্রিয় গান।

১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল, এই ১০ বছরেই দুজন একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। পরের ১৮ বছরে বাপ্পী মাত্র একটি গান লিখেছেন আইয়ুব বাচ্চুর জন্য। বাপ্পী বলেন, 'টুকটাক মান-অভিমান হয়েছে ঠিক, কিন্তু সম্পর্কের সুতাটা ছিড়ে যায়নি কখনোই। বসের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটুট ছিল। নিজের পরিবারের চেয়েও বেশি প্রাধান্য তিনি দিয়ে গেছেন সংগীতে। এমন সংগীতব্যক্তিত্ব একটা দেশে একবারই জন্মায়। আল্লাহ আইয়ুব বাচ্চুকে বেহেশত নসিব করুন।'

Comments

The Daily Star  | English
gold price rises in Bangladesh

Gold shines through 2025 amid price volatility

If there were a “metal of the year” award, gold would be a strong contender, maintaining an exceptional run even on the final trading day of 2025..Businesspeople said the retail gold market in Bangladesh has remained unstable over the past few months, driven by fluctuating global prices, s

8m ago