এখনো জনপ্রিয় ‘মেলোডি কিং’ শেখ ইসতিয়াকের গান

'নীলাঞ্জনা, ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখো না/ তোমার ওই দুটি চোখে আমি হারিয়ে গেছি/ আমি বোঝাতে তো কিছু পারিনা'—এখনো লোকের মুখে মুখে ফিরে এই গান। সময়টা ১৯৮৬ সাল। মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ শিল্পী শেখ ইসতিয়াকের অ্যালবাম 'নন্দিতা'।
এই ক্যাসেটটি তখন পেয়ে গেছে তুমুল জনপ্রিয়তা। 'নীলাঞ্জনা' গানটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেলেও অ্যালবামের 'আমার মনের ফুলদানিতে', 'নন্দিতা' গানগুলোও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। শেখ ইসতিয়াক শিল্পী হিসেবে পেয়ে যান ব্যাপক পরিচিতি। সে বছরই চলচ্চিত্রেও প্লে ব্যাক করেন, তবে সেদিকে পরে আর খুব একটা যাননি।
শেখ ইসতিয়াকের জন্ম ১৯৬০ সালে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ১৯৭৪ সালে 'সন্ন্যাসী' নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন। ছোটবেলা থেকেই গান শিখতেন। ক্লাসিকালে ভালো তালিম ছিল তার, ছিল প্রখর মাত্রাজ্ঞান। তার সংগীতজীবন আরও সমৃদ্ধ হয়েছিল লাকী আখন্দের স্পর্শে। শেখ ইসতিয়াক গিটার নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। লাকী আখন্দ ও হ্যাপি আখন্দের সাহচর্য তাকে গিটারে আরও আগ্রহী করে তোলে, দক্ষতাও অনেক বাড়িয়ে দেয়। লাকী আখন্দ তাকে হ্যাপি আখন্দ ও নিলয় দাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের আরেকজন সেরা গিটারিস্ট মনে করতেন। লাকী আখন্দের 'এই নীল মণিহার' গানে গিটার শেখ ইসতিয়াকের বাজানো।
শেখ ইসতিয়াক সর্বমোট সাতটি একক অ্যালবাম করেছিলেন। এর বাইরে কিছু মিক্সড অ্যালবামে গেয়েছেন। তার অন্যান্য গানগুলোর ভেতর 'টিপ টিপ বৃষ্টি', 'অভিযোগ নেই', 'ভুল করে যদি ডাকো কোনোদিন', 'একদিন ঘুম ভেঙে দেখি', 'নীল টেলিফোন', 'যেখানে পথের শেষ', 'ভোরের শিশিরে', 'বড় বেশি মনে পড়ে', 'তুমি অভিমানী', 'শোনো আমি কি সেই জন যাকে খোঁজো' খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। 'শোনো আমি কি সেই জন' গানটি লায়োনেল রিচির 'হ্যালো' অবলম্বনে লিখেছিলেন ও তৈরি করেছিলেন হানিফ সংকেত।

এমনকি কুমার বিশ্বজিতের জনপ্রিয় গান 'যেখানে সীমান্ত তোমার' গানটিও প্রথম গেয়েছিলেন শেখ ইসতিয়াক। সুরকার লাকী আখন্দ তাকে দিয়ে গানটি রেকর্ড করান আশির দশকের শুরুতে। তবে সেই রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়নি, সেটি আর পাওয়াও যায় না। এছাড়া, লাকী আখন্দ তার 'পলাতক সময়ের হাত ধরে' গানটিও প্রথম রেকর্ড করিয়েছিলেন শেখ ইসতিয়াককে দিয়েই। যদিও ইসতিয়াকের গায়কীতে কিশোর কুমারকে অনুসরণ করা নিয়ে তার অভিযোগ ছিল, কিন্তু তিনি ইসতিয়াককে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, তার মৃত্যুতে ভাই হ্যাপি আখন্দকে হারানোর মতো ব্যথাই অনুভব করেছিলেন।
শেখ ইসতিয়াক মারা যান ১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, আজ থেকে ঠিক ২৬ বছর আগে। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। তার হার্টে সমস্যা ছিল ছোটবেলা থেকেই। চিকিৎসক জরুরি অপারেশন করার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু শর্ত ছিল, হার্টের অপারেশন করালে তিনি আর গান করতে পারবেন না। চিরতরে বিদায় জানাতে হবে গানকে। গানই ছিল শেখ ইসতিয়াকের জীবনের প্রথম ভালোবাসা। চিরতরে গান ছেড়ে দিতে হবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই নিয়মিত ওষুধ খেলেও হার্টের অপারেশনটা আর করাননি।
১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। তার স্ত্রী সে সময় মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে পরে প্রতিবেশীদের সহায়তায় দরজা ভাঙা হয়। দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর আগে তার শেষ অ্যালবাম ছিল 'তুমি অভিমানী'। মৃত্যুর পর সাউন্ডটেক থেকে তার গানের সংকলন 'নীলাঞ্জনা' প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত, সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুলকে এক অনুষ্ঠানে দেওয়ার জন্য উপহার কিনে রেখেছিলেন শেখ ইসতিয়াক। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা আর দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেই উপহার পরে শেখ ইসতিয়াকের স্ত্রী (পুনম প্রিয়াম) তাকে দিয়েছিলেন, যা পেয়ে তিনি প্রচণ্ড ব্যথিত ও আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন।
শেখ ইসতিয়াক তার জীবদ্দশায় পরিচিতি পেয়েছিলেন 'মেলোডি কিং' হিসেবে। একজন সহানুভূতিশীল, সজ্জন মানুষ হিসেবে অডিও ইন্ডাস্ট্রিতেও ছিলেন অনেকেরই প্রিয়। নিজের কাজ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন সবসময়। তিনি আজ নেই, কিন্তু গানগুলো রয়ে গেছে তার সৃজনক্ষমতার সাক্ষর হিসেবে। এখনো শ্রোতাদের হৃদয়ে অনুরণন তুলে যায় শেখ ইসতিয়াকের গান।
Comments