অন্তরাত্মার গান ও আমাদের বেঁচে থাকার গল্প
'আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো/ আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনা বালি তীর ধরে বহু দূর বহু দূর হেঁটে এসেছ/ আমি কখনো যাইনি জলে, কখনো ভাসিনি নীলে/ কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে/ আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে/ আমাকেও সাথে নিও/ নেবে তো আমায়, বলো নেবে তো আমায়?'
এই গানটি শোনেননি এমন সংগীতপ্রেমী হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। এই গানটির কথা উঠে এলেই একটি নাম আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে—'মৌসুমী ভৌমিক'।
মৌসুমী ভৌমিকের গান অন্তরাত্মার গান। এই গান বিনোদনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। মানুষের জীবনের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা, নানাবিধ সংকটের কারণে মানুষ মানুষের পাশে পারে না দাঁড়াতে৷ তা ছাড়া, বিংশ শতাব্দী-পরবর্তী জীবন ও সভ্যতার পৃথিবী মূলত মুনাফার পৃথিবী৷ এই পৃথিবীতে অল্প কিছু মানুষের মুনাফা তৈরির জন্য দিন-রাত খেটে মরছে অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু সেসব মানুষও দিনশেষে তার একান্ত গহন ও আপন ভুবনে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, খুঁজে পেতে চায় হারিয়ে ফেলা মানুষদের। আর তখনই মৌসুমী ভৌমিকের গান তাদের সঙ্গী হয়৷ আমাদের কানে বাজতে থাকে—'কেন শুধু ছুটে চলা/ একই একই কথা বলা/ নিজের জন্যে বাঁচা নিজেকে নিয়ে/ যদি ভালোবাসা নাই থাকে/ শুধু একা একা লাগে/ কোথায় শান্তি পাব, কোথায় গিয়ে/ বলো কোথায় গিয়ে।'
এরপরও মানুষ সুদিনের স্বপ্ন দেখে। তারা স্বপ্ন দেখতে চায়, এখনো শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষ মানুষের জন্য ভাবে, নিজস্ব সীমা ও সামর্থ্যের ভেতরে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এটা সব মানুষই হয়তো পারে। তবে কেউই সবসময় পারে না। এ কারণে মানুষের ওপর আস্থা রাখার ব্যাপারে ভাবা যায়, আস্থা রাখাও যায়। আর সেই কথাগুলোই গানে বলেন মৌসুমী—'আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো স্বপ্ন দেখো/ এখনো গল্প লেখো গান গাও প্রাণ ভরে/ মানুষের বাঁচা মরা এখনো ভাবিয়ে তোলে/ তোমাদের ভালোবাসা এখনো গোলাপে ফোটে/ আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ/ তোমাদের কাছে এসে দু হাত পেতেছি...'
এর বাইরে মৌসুমী ভৌমিকের গান আমাদের সবসময়ই দেয় সংবেদনশীলতার সন্ধান। যেমন: 'এখানে সকাল নাম ধরে ডাকে/ এখানে দুপুর রোদে জলে মেশা/ এখানে শীত পাতা ঝরা/ তবু থাকতে চেয়েও থাকতে পারি না/ এখানে সকাল নাম ধরে ডাকে/ কোথাকার এক বাউন্ডুলে পাখি/ জানলায় এসে নাম ধরে ডাকে/ কেমন করে নিজেকে বোঝাই/ সেই ডাকে আমি ভোরকে দেখিনি?'
গানটির অপার স্নিগ্ধতা আর নিজস্ব অক্ষমতার কারণে জীবনের আহ্বানে সাড়া দিতে না পারার যে আক্ষেপমিশ্রিত শূন্যতার বোধ, তা গানটিকে করে তোলে বিশ্বজনীন।
মৌসুমী ভৌমিকের বেশ জনপ্রিয় গান 'আমি যা দেখি তুমি তা দেখ কি' আবার আমাদের শেখায় নিজের বোঝাপড়াকে প্রশ্ন করতে। 'দেয়ালে স্লোগান দেখে আমি বলি লাল তুমি বলো/ থোকা থোকা রঙ গোল লাল/ লাল আগুনের রঙ লাল/ দেখো কপালে টিপের রঙ লাল/ বিকেল আকাশটাও লাল।'—এভাবে এক লাল রঙকে নানান প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে তার ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করেছেন মৌসুমী।
আবার, জীবনের ক্ষণস্থায়ী সংক্ষিপ্ত ব্যাপ্তির ভেতরই আমাদের নিজস্ব শূন্যতাকে পূরণ করার যত রকম আয়োজন, নিজেদের ভেতরের অনিরাপত্তা ও হীনমন্যতাকে ঢেকে দেওয়ার যত রকম চেষ্টা, তাও মূর্ত মৌসুমী ভৌমিকের গানে৷ 'আমার ঘরের পাশে তোমার বাড়ি হবে/ তাই দেখি দিনরাত মাটি খোঁড়াখুঁড়ি/ ইট-কাঠ-সুরকি লোহার পোক্ত ফ্রেম/ জানলার গ্রিল আর দেয়ালে দেয়াল/ যখন দেখি তুমি পোক্ত বাড়ির ফ্রেমে আঙ্গুল বোলাও/ তখন ভাবি আমি পলকা মানুষগুলো কদিন বাঁচে।'—গানটি শুনলে এভাবেই ব্যাপারগুলো মেলানো যায়, প্রশ্ন করা যায় নিজেদের।
'চিঠি' গানটিতে মৌসুমী লিখেছেন—'এখন সকাল এখানে সকাল মেঘলা সকাল/ মাটি ভেজা ভেজা গন্ধ/ তোমার আকাশে কত তারা ভাসে/ তুমি দেখ না তো তোমার জানালা বন্ধ/ তোমার চিঠি কালকে পেয়েছি/ ক হাজার মাইল পেরিয়ে এসেছে/ তোমার কথার ছন্দ/ একা একা রাত কাটানো কবরে/ কুয়াশা ছড়ানো ভোরের খবরে/ পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব।'
এই গানটি আমাদের জীবনের শত সংকটের মাঝেও সম্ভাবনাগুলোকে অনুভব করতে ও পরখ করে দেখতে উৎসাহিত করে। জীবনের জানালা বন্ধ করে রাখলে যেমন আকাশের তারার সৌন্দর্য বা জোছনার আলো দেখা যায় না, তেমনি কুয়াশায় মোড়ানো ঠাণ্ডা ভোরের পরেই আসতে পারে মিষ্টি রোদের সকাল।
আর সব সংকট, প্রতিকূলতার পরেও প্রতিটি মানুষ তাদের জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোর কাছে ফিরতে চায়, সেসব স্মৃতি বুকে নিয়ে বাঁচে। এ কারণে মানুষের সংবেদনশীলতা ও সহমর্মিতা পুরোপুরি নষ্ট হতে পারে না কখনো। মৌসুমী ভৌমিকের 'বৃষ্টি পড়ে রে' গানটি শুনলে এই মায়াময়তা শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, যা গানটিকে করে তোলে সার্বজনীন।
'ভেজা আকাশ, ভেজা মাটি/ ভেজা পথে আমরা হাঁটি/ গা ভিজে যায়রে, বৃষ্টি পড়েরে/ ভেজা উঠোন, ভেজা বাড়ি/ ভেজা ছাদে মায়ের শাড়ি/ জল জমেছেরে, শহর জুড়েরে/ বৃষ্টি পড়েরে, শহর জুড়েরে/ পথের পাশে ছোট্ট ছেলে/ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলে/ ভয় পেয়ে যায়রে, মেঘের ডাকেরে/ ভয় পেয়ে যায়রে, বৃষ্টি পড়েরে।'
একসময় নানাবিধ দায়িত্ব ও কর্তব্যে ন্যস্ত আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় বৃষ্টিতে ছাদে ভেজা মায়ের শাড়ি, ভেজা উঠোন, রাস্তার পাশে ভিজতে থাকা ছোট ছেলেকে দেখতে থাকা কিংবা মেঘের গর্জনে ভয় পাওয়ার অবসর। কিন্তু বৃষ্টি পড়া থামে না, আমরা দূর থেকে বৃষ্টি ঝরার শব্দ শুনতে পাই, দেখতে পাই। বৃষ্টিতে ভিজতে হয়তো পারি না, কিন্তু কখনো টিপটিপ করে, কখনো ঝমঝমিয়ে আমাদের বুকের ভেতর অনবরত বৃষ্টি পড়তে থাকে।

Comments