অভিমানী এক অ্যাকশন চলচ্চিত্র পরিচালক
ঢাকাই সিনেমার অ্যাকশন সিনেমার পরিচালক দেওয়ান নজরুল। সত্তর ও আশির দশকের একজন জনপ্রিয় পরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন সিনেমা 'দোস্ত দুশমন' নির্মাণ করেছেন তিনি। শুধু পরিচালনা নয় সিনেমার অনেক জনপ্রিয় গানও লিখেছেন। ঢাকাই বাণিজ্যিক সিনেমায় অসামান্য অবদান তার। দোস্ত দুশমন ছাড়াও নির্মাণ করেছেন—'আসামি হাজির', 'কালিয়া', 'বারুদ', 'জনি', 'মাস্তান রাজা', 'জিঘাংসা', 'জনি', 'বাংলার নায়ক', 'ধর্ম আমার মা', 'দোজখসহ' ১৭ সিনেমা।
অভিমানী এই বরেণ্য পরিচালক প্রথমে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। গণমাধ্যমের কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন তিনি। পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমনের সহযোগিতায় এবং প্রতিবেদকের একান্ত ইচ্ছার কথা জানার পর দীর্ঘ ৪০ বছর পর দ্য ডেইলি স্টারকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন খ্যাতিমান এই পরিচালক।
ডেইলি স্টার: কেমন আছেন?
দেওয়ান নজরুল: এই তো ভালো আছি, বেঁচে আছি। এই সময়ের কেউ তো আমাকে সেই অর্থে চেনে না। কী হবে আমার কথা জেনে। সিনেমার তো কেউ আর সেভাবে আমাকে স্মরণ করে না। এখনকার মিডিয়ার কেউ তেমন চেনে না আমাকে।
ডেইলি স্টার: আপনার নির্মিত 'দোস্ত দুশমন' সিনেমা অনেক আলোচিত। এই সিনেমার কথা বাংলা সিনেমা যারা পছন্দ করেন তারা জানেন। এই বিষয়ে কিছু বলেন?
দেওয়ান নজরুল: আমার পরিচালিত 'দোস্ত দুশমন' বাংলা সিনেমার প্রথম অ্যাকশন সিনেমা। এই সিনেমা দিয়ে বাংলা সিনেমার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই আমার বদনাম করতে শুরু করলেন। সেই কারণে 'আসামি হাজির' সিনেমা নির্মাণ করে বুঝালাম সব ধরনের সামাজিক ছবি আমিও করতে পারি, সেটা করে দেখালাম। এই ছবিটাও ব্যাপক ব্যবসা করেছিল।
ডেইলি স্টার: 'দোস্ত দুশমন' সিনেমার বাজেট কত ছিল। সেসময়ে কেমন ব্যবসা করেছিল সিনেমাটি?
দেওয়ান নজরুল: এই সিনেমাতে ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল, সেন্সরে যাওয়া পর্যন্ত। ব্যাপক ব্যবসা করেছিল, সিনেমাটি মুক্তির পর সারা দেশে ব্যাপকভাবে চলে। তখন সামাজিক পারিবারিক ছবি বেশি চলতো। 'দোস্ত দুশমন' বাংলা ছবির ধারা বদলিয়ে দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে 'বাংলার নায়ক' সিনেমার মাধ্যমে চিত্রনায়ক রিয়াজকে তিনি সিনেমায় আনেন।
ডেইলি স্টার: আপনার লেখা অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে সিনেমায়? সেই গানগুলোর কথা বলেন?
দেওয়ান নজরুল: আমি আসলে সিনেমার দৃশ্যগুলোকে মাথায় রেখে গান লিখেছি। যাকে 'সিন ফর সং' বলে। এই কারণে আমার গানগুলো একেক রকমের, একেক স্টাইলের হয়েছে। সেই গানগুলো হিট হয়েছে। আমার লেখা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—'পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার', 'চুমকি চলেছে একা পথে', 'চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে', 'এক চোর যায় চলে', 'রূপে আমার আগুন জ্বলে', 'দুনিয়াটা মস্ত বড়', 'আজকে না হয় ভালোবাসো আর কোনোদিন নয়', 'নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবি রে', 'আমার পৃথিবী তুমি তোমার পৃথিবী আমি', 'ও সাগর কন্যারে তোর কাঞ্চা সোনা গায়' গানগুলো।
ডেইলি স্টার: সিনেমা নির্মাণ আপনার জন্য কী?
দেওয়ান নজরুল: আমি সর্বশেষ ২০০৫ সালে 'দোজখ' নামে সিনেমা নির্মাণ করেছি। দীর্ঘদিন আর সিনেমা নির্মাণ করিনি, বানিয়েছি। প্রতিটি সিনেমায় ছিল আমার জন্য একটা যুদ্ধ। আমি আসলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম বলে এই যুদ্ধও জয় করতে পেরেছি। আমি যেমন যুদ্ধ করেছি, আমার সিনেমার হিরোগুলো প্রত্যেকেই যোদ্ধা ছিলেন।
ডেইলি স্টার: এই সময়ের সিনেমা প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
দেওয়ান নজরুল: সিনেমার চিত্রনাট্য, গান, অ্যাকশন সবকিছু কিন্তু আলাদা। এটা এই সময়ের অনেকেই বোঝেন না। নাটকগুলো একটু বড় করে সিনেমা বলে চালানো হচ্ছে। নাটক, বিজ্ঞাপন এবং সিনেমার ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। সিনেমার ক্ষেত্রে গান, চিত্রনাট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন যারা ছবি বানান তাদের ধৈর্য ধরে ছবি বানাতে হবে, সিনেমা বানানোর আগে ঠিকভাবে স্টাডি করতে হবে।
ডেইলি স্টার: আপনি ১৭টি সিনেমা বানিয়েছেন। প্রতিটা সিনেমা ব্যবসাসফল ও আলোচিত হয়েছে। আপনার কোনো অপ্রাপ্তি রয়েছে?
দেওয়ান নজরুল: আমি ১৭টি সিনেমা নির্মাণ করে দর্শকদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু কেন জানি আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অ্যাওয়ার্ড পাইনি। কী কারণে আমার কথা সিনেমার যারা পুরস্কার দেন, তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি, জানি না। মানুষের অনেক ভালোবাসা ও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। শত শত গান লিখেছি, তাদের জন্য কাজ করেছি, মানুষ আমাকে আমার কাজের মাধ্যমে ভালোবাসা দিয়েছেন।
ডেইলি স্টার: বর্তমানে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
দেওয়ান নজরুল: বর্তমানে বাড়িতে বসে গান, গল্প লিখছি, কাব্য রচনা করছি। এভাবেই এখন আমার সময় কাটছে। মাঝেমধ্যে স্মৃতি যখন বেশি অনুভব করি এফডিসিতে এসে ঘুরে যাই, পরিচালক সমিতিতে আসি।


Comments