সিনেমার পর্দায় ‘পাশের বাড়ির ছেলেটি’

তাপস পাল, তাপস পাল জন্মদিন, পাশের বাড়ির ছেলেটি তাপস পাল, বাংলা সিনেমা অভিনেতা, তাপস পাল চলচ্চিত্র, দাদার কীর্তি সিনেমা, সাহেব সিনেমা, গুরুদক্ষিণা সিনেমা, তাপস পাল অভিনয়, টালিগঞ্জ সিনেমা, বাংলা সিনেমার নায়ক, উত্তম কুমার পরবর্তী নায়ক, তাপস পাল সিনেমার তালি
তাপস পাল। ছবি: সংগৃহীত

সময়টা ১৯৮০ সাল। উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর দিশেহারা কলকাতার সিনেমা অঙ্গন। ওরকম দুর্দান্ত অভিনেতা, সুদর্শন নায়ক, মোটকথা এমন ম্যাটিনি আইডল আর কেউ কি হতে পারেন? কোথায় পাওয়া যাবে এমন অভিনেতা? সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিরই বা কী হবে?

এমন নানান চিন্তার ছাপ যখন টালিগঞ্জের কপালে, তখনই ১৯৮০ সালের শেষদিকে মুক্তি পেল তরুণ মজুমদারের 'দাদার কীর্তি'। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটিতে অভিষেক হলো নতুন এক অভিনেতার। মাত্র ২২ বছর বয়সী এই অভিনেতার নাম তাপস পাল। প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র। তরুণ বাবু তাকে দেখেন এক ট্রেনে। দেখেই পছন্দ হয়ে যায়।

ছেলেটি যেমন সরল, তেমনই লাজুক। আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলেও শুটিংয়ে এসে দেখা গেল সহশিল্পী মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছেন তিনি। মহুয়ার আন্তরিকতা তাপসকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সহজ করে তোলে।

'দাদার কীর্তি' মুক্তি পাওয়ার পর ব্লকবাস্টার হিট হয়। সরল, শান্ত, পাশের বাড়ির ছেলে—ইমেজের তাপস পাল পেয়ে যান ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তার অভিনীত চরিত্র 'কেদার' তখন সবার আপন।

এরপরই বিজয় বসুর 'সাহেব'। নিম্নবিত্ত পরিবারের এক তরুণ ফুটবলার। সংসারে বিশেষ মনোযোগ নেই, যাবতীয় মনোযোগ ফুটবলে। কিন্তু একসময় সামনে এলো কঠোর বাস্তবতা। গুরুতর রোগ, প্রয়োজন অপারেশন। বেছে নিতে হবে যেকোনো একটি—হয় জীবন, নয় ফুটবল। এই সিনেমায় ক্লাইম্যাক্সে যে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন তাপস পাল, তা সিনেমাটি দেখেছেন এমন কারো পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়।

সিনেমার নায়ককে যে 'লার্জার দ্যান লাইফ' না হলেও চলে, আমাদের চারপাশের আটপৌরে সরল একটা ছেলেও যে হয়ে যেতে পারে নায়ক—সেটিই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তাপস পাল।

তাপস পাল, তাপস পাল জন্মদিন, পাশের বাড়ির ছেলেটি তাপস পাল, বাংলা সিনেমা অভিনেতা, তাপস পাল চলচ্চিত্র, দাদার কীর্তি সিনেমা, সাহেব সিনেমা, গুরুদক্ষিণা সিনেমা, তাপস পাল অভিনয়, টালিগঞ্জ সিনেমা, বাংলা সিনেমার নায়ক, উত্তম কুমার পরবর্তী নায়ক, তাপস পাল সিনেমার তালি
ছবি: সংগৃহীত

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'অজান্তে' (কাহিনী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়), তপন সিনহার 'বৈদুর্য রহস্য', তরুণ মজুমদারের 'ভালোবাসা ভালোবাসা' সিনেমাগুলোর কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। হোটেলে গান করা এক সরল গায়ক, একজন রহস্য উন্মোচক (ঠিক গোয়েন্দা নয় যদিও) কিংবা একেবারেই আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো এক তরুণ—তাপস সবসময়ই তার সাবলীল অভিনয় দিয়ে চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করেছেন।

তার নিজের প্রযোজিত 'অনুরাগের ছোঁয়া' সিনেমায় দ্বৈত চরিত্র করেছেন। কাহিনীতে দ্বন্দ্বের জায়গাগুলো চমৎকার ফুটিয়েছেন। 'আমি যে কে তোমার' কিংবা 'যা পেয়েছি আমি তা চাই না' গানগুলোতে তার এক্সপ্রেশন অনবদ্য। যে বিরহ, রিক্ততা তিনি প্রথমোক্ত গানটিতে ফুটিয়ে তোলেন, তা অনবদ্য।

দীনেন গুপ্তের 'অন্তরঙ্গ' সিনেমাতেও (কাহিনীকার শক্তিপদ রাজগুরু) তার সঙ্গী হাতি 'বীর বাহাদুর'-এর সঙ্গে তার কেমিস্ট্রি উপভোগ্য। এই সিনেমার 'কথা নয় যেন পাখির কূজন' গানে তার সেই স্মিত হাসি আর সারল্যপূর্ণ চাহনি গানটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

তাপসের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ তিনি খুব ছোট ছোট দৃশ্যেও রেখেছেন। যেমন—শচীন অধিকারীর 'চোখের আলোয়' সিনেমায় 'ওই শোনো পাখিও বলছে' গানের রোমান্টিকতা কিংবা 'আর কত রাত একা থাকবো' গানের একদম শেষে তার নির্মল, নিষ্পাপ চাহনি—তার শক্ত অভিনয়-ক্ষমতার প্রমাণ।

তরুণ মজুমদারের 'পরশমণি' কিংবা 'আপন আমার আপন' সিনেমাগুলোতেও আমরা একেবারে সাধারণ কিন্তু সাবলীল তাপস পালকে দেখি, স্ক্রিন ডমিনেট করতে পারেন নির্দ্বিধায়।

এক্ষেত্রে একটি সিনেমার কথা না বললেই নয়। অঞ্জন চৌধুরীর 'গুরুদক্ষিণা'। এই সিনেমায় একজন সংগ্রামরত গায়কের চরিত্রে তার অভিনয় অনবদ্য। বিশেষত ক্লাইম্যাক্সে রঞ্জিত মল্লিক যখন তাকে চাবুক মারেন, সে সময়ের এক্সপ্রেশন প্রমাণ করে তিনি কত বড় অভিনেতা ছিলেন। আবার অঞ্জন চৌধুরীরই 'মহাজন' সিনেমায় অহংকারী এক যুবকের চরিত্র করেন। এই সিনেমায় স্কুলশিক্ষক রঞ্জিত মল্লিককে চাবুক মারার দৃশ্যে তার নৃশংসতা ও ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যে অনুতাপ—দুটোই উল্লেখযোগ্য।

তাপস পাল, তাপস পাল জন্মদিন, পাশের বাড়ির ছেলেটি তাপস পাল, বাংলা সিনেমা অভিনেতা, তাপস পাল চলচ্চিত্র, দাদার কীর্তি সিনেমা, সাহেব সিনেমা, গুরুদক্ষিণা সিনেমা, তাপস পাল অভিনয়, টালিগঞ্জ সিনেমা, বাংলা সিনেমার নায়ক, উত্তম কুমার পরবর্তী নায়ক, তাপস পাল সিনেমার তালি
ছবি: সংগৃহীত

বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের 'নীলিমায় নীল' সিনেমায় একজন ইতিহাস বিভাগের একজন আদর্শবান প্রভাষকের চরিত্রেও তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন। টাকার জন্য গাইড বই লিখতে রাজি হওয়া, চোখের সমস্যা নিয়ে কষ্ট করে লেখা, লিখতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠা, তারপর সেই টাকায় তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া স্ত্রীকে দামি উপহার পাঠানো—এই সবকিছুতে যে গভীরতা তার অভিনয়ে ফুটে ওঠে, তা অনন্য, অসাধারণ।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছেন তাপস পাল। তার 'উত্তরা' সিনেমাটির কথা না বললেই নয়। সমরেশ বসুর কাহিনী থেকে নির্মিত এই সিনেমায় 'নিমাই' চরিত্রটিতে অনবদ্য অভিনয় করেন তাপস পাল।

তার শেষদিকের আরেকটি স্মরণীয় কাজ বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের '৮:০৮ এর বনগাঁ লোকাল'। এই সিনেমায় একজন ছাপোষা কেরানি থেকে তিনি কীভাবে ধর্ষকদের বিচারবহির্ভূতভাবে খুন করতে শুরু করেন—সেই জার্নিটা যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। শেষে গুলিবিদ্ধ হয়ে পুলিশ অফিসারকে যখন বলেন, তার মেয়ের জন্য কেনা পুতুলটা মেয়ের কাছে পৌঁছে দিতে—তখন দর্শকের পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তাপস পাল জন্মেছিলেন ১৯৫৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। বেঁচে থাকলে আজ ৬৭ বছর পূর্ণ করে ৬৮-তে পা রাখতেন। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।

উত্তম কুমার পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে তাপস পাল রেখেছিলেন তার স্বীয় অভিনয় দক্ষতার সাক্ষর। তার সারল্য, তার মায়াময়তা তাকে পরিণত করেছিল 'পাশের বাড়ির ছেলে'-তে। ব্যক্তিজীবনেও প্রতিবেশীদের সঙ্গে, পাড়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতেন তিনি, নিরহংকার জীবনযাপন করতেন আর দশজন মানুষের মতোই। তাপস পালের জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি রইলো আন্তরিক শ্রদ্ধা।

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

10h ago