আড়াই হাজার বছর আগে যে কারণে পাল্টে গিয়েছিল গঙ্গার গতিপথ
পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা টেকটোনিক প্লেট দিয়ে তৈরি, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। এই টেকটোনিক প্লেটগুলোর স্থানান্তরের ফলে ঘটে ভূমিকম্প। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ ব্যাপক ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন, ভূমিকম্প নদীর গতিপথও পাল্টে দিতে পারে। তারা দেখেছেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গঙ্গার গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে। এমনটাই বলা হয়েছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।
গঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বত। এই নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। চলার পথে এটি ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশাল বদ্বীপ গঠন করেছে।
২০২৪ সালের জুনে ন্যাচার কমিউনিকেশনসে গাঙ্গেয় বদ্বীপ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। নেদারল্যান্ডসের ভাহানিঙ্গেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড রিসার্চের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এলিজাবেথ চেম্বারলেইন এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন।
চেম্বারলেইন ও তার দলের সদস্যরা ঢাকার দক্ষিণে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকায় পর্যবেক্ষণ চালান। এতে তারা স্যাটেলাইট মানচিত্র এবং ডিজিটাল উচ্চতার মডেল ব্যবহার করেন, যা নদীর আগের চলাচলের পথকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
এই গবেষক বলেন, গবেষণার জন্য এই বদ্বীপ দারুণ জায়গা। কারণ, এখানে বড় ও গতিশীল নদী-নালা রয়েছে। নদী সম্পূর্ণভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া স্বাভাবিক এবং আমরা এটিকে 'অ্যাভালশন' বলি।
বিজ্ঞানীরা গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে এই ধীর ও নিয়মিত অ্যাভালশন প্রক্রিয়ার প্রমাণ খুঁজছিলেন। এ সময় তারা সুদূর অতীতে অনেক বেশি নাটকীয় কিছু ঘটে যাওয়ার প্রমাণ পান, যা লুকিয়ে ছিল বালুর কণায়।
গবেষণার জন্য প্রায় ৩০০ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটির স্তর থেকে বালু ও কাদার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ভূমিকম্পে তৈরি হয় 'বালুর আগ্নেয়গিরি'
একদিন কাজ শেষে ফেরার পথে রাস্তার পাশে একটি গর্ত দেখতে পান গবেষকরা। চেম্বারলেইন বলেন, 'এটি সদ্য খোঁড়া ছিল। আমরা গর্তের দেয়ালের বিন্যাসে পলিমাটির স্তরগুলো দেখতে পাই। তাই এর মধ্যে নেমে গিয়েছিলাম।'
গবেষকেরা গর্তে তিন মিটারের মতো উচ্চতার বালুর একটি খাড়া স্তম্ভ দেখতে পান। এটি ভূমিকম্পে প্রভাবিত নদীর তলদেশের একটি বিশেষ চিহ্ন।
'ভূমিকম্পের দুলুনিতে বালু ও কাদা সরতে থাকে। কিন্তু কাদা বালুর মতো সরতে পারে না। কাদা খুব চটচটে, একসঙ্গে লেগে থাকে, আর বালুর কণাগুলো আলাদা আলাদা সরতে থাকে, বিশেষ করে যখন এগুলো পানির মধ্যে থাকে।'
যখন ভূমিকম্পের সময় বালুর কণাগুলো নড়তে থাকে, তখন তারা বেশি স্থান দখল করে। আর যদি কাদা তাদের চারপাশ থেকে আটকে রাখে, তাহলে চাপ তৈরি হয়।
চেম্বারলেইন বলেন, চাপ যথেষ্ট বেশি হলে বালু সেই কাদার মধ্য দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে পারে এবং তা কার্যত একটি বালুর আগ্নেয়গিরি তৈরি করে।
এই গবেষণায় চেম্বারলেইনের সঙ্গে কাজ করেছেন নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুল লামন্ট-আর্থ অবজারভেটরির ভূ-ভৌতবিজ্ঞানী মাইকেল স্টেকলার। ২০১৬ সালে তিনি গঙ্গা অববাহিকায় ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের কারণ বোঝার জন্য টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া পুনঃচিত্রায়ন করেন।
তার গবেষণায় দেখা যায়, ভূমিকম্পের মূল উৎস সেই বালুর আগ্নেয়গিরি থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে ছিল। বালুর আগ্নেয়গিরির বড় আকার দেখে মনে হয় ভূমিকম্পের মাত্রা অন্তত ৭ বা ৮ ছিল, যা ১৯০৬ সালের সান ফ্রান্সিসকোতে ঘটা ভূমিকম্পের মাত্রার সমান।
পলিমাটি সামনে আনল প্রাচীন রহস্য
মহা-ভূমিকম্পটি কতকাল আগে ঘটেছিল তা নির্ধারণ করতে চেম্বারলেইন এবং তার সহকর্মীরা একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যাকে বলা হয় অপটিক্যালি স্টিমুলেটেড লুমিনেসেন্স।
তিনি বলেন, এটি সরাসরি বালু বা কাদার কণার ওপর কাজ করে এবং দেখে কখন এই কণাগুলো শেষবার সূর্যের আলোতে এসেছিল।
যখন মাটির নিচে পলি চাপা পড়ে, তখন এটি কম মাত্রার বিকিরণের সংস্পর্শে আসে এবং সেই শক্তি জমা রাখে। আলোর সংস্পর্শ এড়াতে একটি অন্ধকার কক্ষে চেম্বারলেইন এবং তার দলের সদস্যরা একটি যন্ত্র ব্যবহার করে পরিমাপ করেছেন যে, কণাগুলো কতটা বিকিরণে এসেছিল।
এর মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন, ভূমিকম্পের কারণে ওপরের মাটি কতকাল আগে চাপা পড়েছিল। গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, বালুর আগ্নেয়গিরিগুলো প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল।
এসব বালুর আগ্নেয়গিরির প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে বিজ্ঞানীরা একটি বড় নদীর রেখা পেয়েছেন, যা প্রায় একই সময়ে কাদায় ভরাট হয়ে গিয়েছিল। এই আবিষ্কার দেখায় যে, আড়াই হাজার বছর আগে নদীর পথ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। সময় ও স্থানের কাছাকাছি এই ঘটনা প্রমাণ দেয় যে আড়াই হাজার বছর আগে একটি মহা-ভূমিকম্প গঙ্গার পথ পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সিভিল ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জোনাথন স্টুয়ার্ট বলেন, এই গবেষণা 'কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ'। কারণ এটি বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প কত ঘন ঘন ঘটে এবং ভবিষ্যতে যদি আরেকটি বড় ভূমিকম্প ঘটে তাহলে কোন অঞ্চলগুলো প্রভাবিত হতে পারে তার বিষয়ে আরও তথ্য দিচ্ছে। তিনি অবশ্য এই গবেষণায় অংশ নেননি।
১৪ কোটির বেশি মানুষের ক্ষতি হতে পারে
এই সময়ে গঙ্গা অববাহিকায় এমন আরেকটি বড় ভূমিকম্প হলে ১৪ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ভাইস প্রভোস্ট সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনার শঙ্কা তুলে ধরে ভূমিকম্প মোকাবিলা ও প্রস্তুতির প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে পারে।
তিনি বলেন, আরেকটি ভূমিকম্প হলে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারি কার্যক্রম—যেমন ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা—সবই জরুরি।
এ ধরনের বড় ঘটনা ঘন ঘন ঘটে না, তাই পৃথিবীর ভূ-প্রক্রিয়ায় কী ঘটে, তার সব কিছুর আধুনিক নথি আমাদের কাছে সবসময় থাকে না, বলেন চেম্বারলেইন।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের গবেষণা আমাদের অতীতের দিকে নজর দিতে সাহায্য করে এবং বুঝিয়ে দেয়, হাজার হাজার বছর ধরে—এমনকি এক লাখ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে পৃথিবী কীভাবে কাজ করেছে বা করতে পারে। আর এটি জানা খুবই জরুরি, কারণ আজ পৃথিবীর ওপরিভাগে আমরা যা দেখছি তার পেছনের কারণ এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে—তা বোঝার জন্য এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।


Comments