এলএনজি আমদানি বাড়লেও গ্যাস সরবরাহ কমছে

দেশের সামগ্রিক গ্যাস সরবরাহ গত অর্থবছরে আরও কমেছে, যদিও এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বেড়েছে। এর কারণ হলো দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের ধারাবাহিক পতন।

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে এবং কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে প্রতিদিন দেশে প্রায় তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে দৈনিক গড় গ্যাস সরবরাহ ছিল দুই হাজার ৫২৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর আগের বছর সরবরাহের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে সরকারের ব্যয় দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।

এত বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানির জন্য সরকারকে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রায় আট হাজার ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৬,০০০ কোটি টাকার তুলনায় বেশি।

অন্যদিকে, দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ২০১৮ সাল থেকে ক্রমাগত কমছে— সেই বছরই প্রথম এলএনজি আমদানি শুরু হয়।

এর পর থেকে প্রতিটি অর্থবছরেই এলএনজি আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, যা এখন মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করছে।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিগত সরকারগুলো আমদানিনির্ভর গ্যাস সরবরাহ কৌশল নিয়েছিল—এটি ছিল একটি মন্দ দৃষ্টান্ত। 

বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মীদের উদ্বেগের মধ্যে ২০২২ সালে তৎকালীন সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি গ্যাস কূপ খননের তিন বছরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। এর  মাধ্যমে দেশীয় উৎস থেকে প্রায় ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ করার লক্ষ্য ছিল।

তবে ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত মাত্র সাতটি কূপ খনন সম্পন্ন হয়। এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৯টিতে।

এ পর্যন্ত এই উৎসগুলো থেকে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে মাত্র ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আরও ১০০টি নতুন গ্যাস কূপ খননের আরেকটি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়।

পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ১৫টি প্রকল্পের আওতায় ৪১টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করেছে।

দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, ছয়টি পৃথক প্রকল্পের অধীনে ১৯টি কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান। এর লক্ষ্য ২০২৮ সালের মধ্যে দৈনিক এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। 

ক্ষমতাচ্যুত সরকার ২০২৪ সালে ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো সমুদ্র এলাকায় (অফশোর) গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ বৈশ্বিক তেল কোম্পানিগুলোর জন্য অফশোর বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করে। তখন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু এর মধ্যেই রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং কোনো অংশগ্রহণকারীই দরপত্র জমা দেয়নি। পরে অন্তর্বর্তী সরকার সময়সীমা আরও তিন মাস বাড়ালেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি খাতে কেবল নিয়মিত কাজকর্মই করেছে।' 

তিনি বলেন, 'তাদের সুযোগ ছিল স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে জোরালোভাবে কূপ খননের, কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই বিষয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো আগ্রহ বা উদ্দীপনা আমরা দেখতে পাইনি।'  তার মতে, 'স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ ক্রমাগত কমতে থাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রমে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।'

ক্যাব উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, 'যারা আগের সরকারের আমদানিনির্ভর নীতিকে সমর্থন করেছিল, তারা এখনো বহাল।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর বাজারে পরিণত করেছে। এসব সিদ্ধান্ত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, আর সেই একই ধারা এখনো অব্যাহত। আগের সরকার যেভাবে জ্বালানি খাতকে অস্থিতিশীল অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল, তা এখনো চলছে—মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াও ক্রমেই আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।' 

পেট্রোবাংলা কর্মকর্তারা জানান, তারা নতুন প্রস্তাবনাগুলোর নথি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে।

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি নির্বাচিত সরকারের ওপরই ছেড়ে দেবে।

Comments