এখনো কেন ৭ কলেজ নিয়ে আন্দোলন?

ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজ একীভূত করে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে সংকট কাটছেই না। বরং এখন এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা অবস্থান তৈরি হয়েছে।

এর একটি পক্ষ চাইছে, দ্রুত প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির চূড়ান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হোক। আরেকটি পক্ষ কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দাবিতে আন্দোলন করছে। আরও একটি পক্ষ প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় চায় না। এসব পক্ষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি দিচ্ছে। কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষ-হাতাহাতির খবরও সামনে আসছে।  

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজ আলাদা হওয়ার প্রেক্ষাপট

২০১৭ সালে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকার রাজধানীর সাতটি কলেজের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসে। এই কলেজগুলো হলো—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ। 

এর আগে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই কলেজগুলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তারও আগে, রাজধানীর পুরনো কলেজগুলো সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। 

শুরু থেকেই জটিলতা

প্রতিষ্ঠার পর কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যাশিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর ফলে শুরু থেকেই পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে বিলম্ব, প্রশাসনিক জটিলতাসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া ঘিরে আন্দোলনের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই সাত কলেজ অধিভুক্তির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার সিদ্ধান্তটি ছিল নেতিবাচক মানসিকতা থেকে নেওয়া। 

এই অধ্যাপকের মতে, তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলই ছিল এই সাত কলেজের অধিভুক্তকরণ।

আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি

সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সবসময়ই বলে এসেছেন, ঢাবি অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। ফলে যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এসব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়েছিল, তা বাস্তবে অর্জিত হয়নি।

বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব কলেজের সার্বিক কার্যক্রমে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বৈষম্যমূলক নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা-সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন বলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজকে স্বায়ত্তশাসিত বা স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা।  

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা আবারো দাবি তুলে সময় বেঁধে দেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে ছিন্ন করতে হবে এবং সাত কলেজের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিতে হবে।

একপর্যায়ে সরকার দাবি মেনে নেয়। এরপর মহাখালীতে অবস্থিত সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে অনশন ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি দেন শিক্ষার্থীরা।

এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানায়, ঢাকার সাতটি কলেজের সমন্বয়ে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি তিতুমীর কলেজের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি

গত মার্চে সরকার ঘোষণা দেয় যে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে একীভূত করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)। নামটি চূড়ান্ত করার আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ইমেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজনের মত নেয়।

ইউজিসি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত রূপরেখা তৈরি করে। বর্তমানে সংসদ কার্যকর না থাকায়, অন্তর্বর্তী সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অধ্যাদেশ আকারে জারির উদ্যোগ নেয়।

অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব পড়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির ওপর। প্রস্তাবিত প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক কাঠামো নিয়ে অংশীজনদের মতামত জানতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করে।

কী আছে খসড়ায়

খসড়া অধ্যাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী, সাত কলেজের অবকাঠামো ও ক্যাম্পাস স্থায়ীভাবে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত) ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, সিন্ডিকেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি হবে হাইব্রিড।

নতুন ধরনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে, আর ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীরে। তবে সব পরীক্ষা হবে সশরীরে।

সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে চারটি স্কুলে ভাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষাক্রম অনুসরণ করলেও ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সনদ পাবেন।

নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা আলাদা সিলেকশন বোর্ড শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের সুপারিশ করবে।

এখন যা নিয়ে আন্দোলন

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত কাঠামোকে কেন্দ্র করে সাত কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বেশ কিছুদিন ধরে ভিন্নমুখী অবস্থান নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

একদিকে কলেজগুলোর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন। ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের অনেক শিক্ষার্থী প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের বিরোধিতা করেছেন।

অন্যদিকে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গড়ার সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করছেন। তারা সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত অধ্যাদেশ জারির আহ্বান জানিয়েছেন।

সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের উদ্যোগে উদ্বেগ জানিয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বর্তমানে এসব কলেজে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের দেড় হাজারের মতো পদ রয়েছে। 

তাদের আশঙ্কা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এসব পদ শিক্ষা ক্যাডার থেকে বাদ পড়বে, ফলে পদোন্নতির প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে উঠবে। এই আশঙ্কায় শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। 

একইসঙ্গে, প্রস্তাবিত কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কলেজগুলোর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং নারী শিক্ষার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।

আন্দোলন ঘিরে গতকাল সোমবার ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে উচ্চমাধ্যমিকের এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও একজন শিক্ষককে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে। 

এর প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার সারা দেশে সরকারি কলেজ, সরকারি মাদরাসা ও অন্যান্য অফিসে দিনব্যাপী সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণ করে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন।

Comments

The Daily Star  | English

Bureaucracy was big supporter of previous govt’s thefts: Debapriya

The economist spoke at a book unveiling event on financial journalism

5h ago