ঢাবি ক্যাম্পাসে হকার উচ্ছেদে ডাকসু কেন? 

উচ্ছেদ অভিযানে ডাকসু সদস্য ও প্রতিবাদে হকারদের মিছিল। কোলাজ ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির পাশে ভ্রাম্যমাণ ফুড কার্টে চার-পাঁচ বছর ধরে মোমো বিক্রি করতেন সাকিব। তার গাড়িটি ভাঙা হয়েছে, মালপত্র মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাকে মারধর করা হয়েছে বলেও অভিযোগে জানান তিনি। কে বা কারা এমন করেছে জানতে চাইলে তিনি ডাকসুর নেতাদের নাম বলেন।

আরেকজন ভাজাপোড়া খাবার বিক্রেতা মনির। তিনি বসতেন রমনা কালীমন্দিরের সামনে। এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, তার দুটো ফুড কার্ট ভাঙা হয়েছে ডাকসুর নেতাদের নেতৃত্বে। তারা ওই দোকানের কর্মচারী তানভীরকে থাপ্পড় দিলে কানে আঘাত পায় ছেলেটি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।

এই অভিযোগগুলোর পেছনের গল্পটা জানা যাক এবার। ক্যাম্পাস থেকে অবৈধ হকার ও ভবঘুরে উচ্ছেদে গত বৃহস্পতিবার থেকে অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রায়ই এ ধরনের কার্যক্রম চালালেও এবারের অভিযানে ডাকসুর নেতারা যুক্ত হয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে দোকান ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ ওঠায় বেশ আলোচিত হচ্ছে অভিযানটি।

ডাকসু নেতাদের ভাষ্য, এই হকার ও ভবঘুরেদের অনেকেই মাদকাসক্ত, এমনকি তারা মাদক কেনাবেচাও করছেন। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নানাভাবে হুমকি তৈরি করছে এই মানুষগুলো।

অন্যদিকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হকারদের উঠিয়ে দেওয়াকে অমানবিক মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বেশ কিছু ছাত্রসংগঠন। এছাড়া, প্রমাণ পাওয়ার আগে কাউকেই 'মাদকসেবী' বা 'মাদক কারবারি' ট্যাগ দেওয়া নিয়েও আপত্তি তুলছেন কেউ কেউ।

প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা ডাকসু এ ধরনের উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারে কি? ডাকসুর গঠনতন্ত্র এ ব্যাপারে কী বলছে? যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলো উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তাদের যুক্তিগুলো কী?

ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধির কারণ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ডাকসু যৌথভাবে এ অভিযানে নেমেছে। ডাকসুর সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবি জুবায়ের ও সদস্য সর্বমিত্র চাকমাকে এ কাজে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকতে দেখা গেছে।

জুবায়ের জানিয়েছে, এই অভিযানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই তাদের ডেকেছে। তারা বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করেই করছে। বিষয়টি জানতে ঢাবি প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদকে গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত কয়েকবারে কল দিলেও তিনি ধরেননি।

তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ঢাবি প্রক্টর যেসব কথা বলেছেন তার সারমর্ম হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা জোরদার করছে। যেহেতু এটা নিশ্চিত করা এককভাবে প্রক্টোরিয়াল টিমের পক্ষে করা সম্ভব নয়, তাই তারা সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা নিচ্ছেন।

ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক যেহেতু আরেকজন সদস্যকে নিয়ে এই উচ্ছেদ অভিযানে বেশ সক্রিয়, সেক্ষেত্রে দেখে আসা যাক সমাজসেবা সম্পাদকের দায়িত্ব সম্পর্কে কী বলা আছে ডাকসুর গঠনতন্ত্রে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্রে সমাজসেবা সম্পাদকের কাজ সম্পর্কে বলা আছে, 'তিনি নিরক্ষরতা দূর করা ও জনগণের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন শুভেচ্ছা সফর ও লেকচারের আয়োজন করবেন, (ছাত্র) সংসদ পরিচালিত স্কুলের কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা করবেন এবং নানা সময়ে নির্বাহী কমিটি কর্তৃক অর্পিত অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব পালন করবেন।'

আবার গঠনতন্ত্রের হল সংসদ অংশে সমাজসেবা সম্পাদক সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'সমাজসেবা সম্পাদক সভাপতি বা কার্যনির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিয়ে প্রয়োজনীয় সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তিনি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কার্যক্রম এবং হলের নাইট স্কুলের (যদি থাকে) দায়িত্বেও থাকবেন।'

গঠনতন্ত্রের কোথাও ডাকসুর নেতৃত্বে এ ধরনের উচ্ছেদ অভিযান চালানো যাবে বা যাবে না, এ ধরনের কোনো কথা বলা নেই। তবে এই অভিযানের নৈতিক ও আচরণগত দিকগুলো নিয়েই মূলত আপত্তি উঠছে।

গত শনিবার রাতে একটি কর্মশালা শেষ করে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাবি শাখার নেতা ইসরাত জাহান ইমু। ওইসময় তার সামনেই টিএসসিতে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক জুবায়ের তার দলবল নিয়ে হকারদের মারধর করছিলেন বলে জানান তিনি। এসময় কয়েকটি ফুড কার্ট ও দোকান ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ইমু বলেন, হকারদের একজনকে কাঠ দিয়ে মারায় তার পা কেটে রক্ত বের হচ্ছিল। তারা তাদের জীবিকার সামগ্রী না ভাঙতে অনুরোধ করছিলেন, কান্নাকাটি করছিলেন। কিন্তু ডাকসু নেতারা তাদের কোনো কথাই শুনছিলেন না। ইমু ও তার সঙ্গীসাথিরা অনেকেই এ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান।
ইমুর মতে, এভাবে কাউকে মারধর করা অমানবিক তো বটেই, তারচেয়ে বড় কথা এটা ফৌজদারি অপরাধ। ডাকসুর কোনো নেতা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এভাবে কাউকে মারধর করতে পারে না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফাও গত ২৫ অক্টোবর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের কোথায় 'গুন্ডামি জায়েজ' আছে জানতে চান।

তবে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক জুবায়ের মারধরের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কাউকেই মারধর করিনি।'

এই অভিযানে তাদের যুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা দেখিয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করা ডাকসুর দায়িত্ব। শুধু অনিবন্ধিত ও অবৈধ দোকানগুলো উচ্ছেদেই আমরা প্রশাসন সাহায্য করছি। এদের কারণে যানজটসহ নানা সমস্যা হয়।

তিনি আরও বলেন, অনেক হকার ও ভবঘুরে আছে, যারা মাদকসেবি, মাদক কেনাবেচার সঙ্গেও যুক্ত। এরা নানা অপরাধমূলক কাজ করে, শিক্ষার্থীদের জন্যও হুমকি তারা।

ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েমও উচ্ছেদের পক্ষে। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেছেন, 'ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে জেঁকে বসা সকল চক্রকে উচ্ছেদ না করে আমরা ক্ষান্ত হব না। বহিরাগত উচ্ছেদে উদাসীনতা দেখালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না।'

এদিকে এই উচ্ছেদের প্রতিবাদে শনিবার রাতে হকার ও ছোট দোকান পরিচালনাকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা বলছেন, ২০-৩০ বছর ধরে তারা ক্যাম্পাসে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে এভাবে হঠাৎ উচ্ছেদ করা অমানবিক।

তাদের এই দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে ক্যাম্পাসের কয়েকটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠন। এমনকি শনিবার রাতে হকারদের মিছিলে তারা অংশও নিয়েছে। সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, এভাবে দুদিন পর পর উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না। এই হকারদের পুনর্বাসনের কথা না ভেবে জোর করে উচ্ছেদ করলে ফলাফল আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই দেখছেন তারা। তাদের জন্য বিকল্প না ভেবে এভাবে মারধর করে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েই মূলত আপত্তি জানিয়েছেন সংগঠনগুলোর নেতারা।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অভিযানকে কেন্দ্র করে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক জুবায়ের ও তার দলবলের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব মীর আরশাদুল হক বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন।

সেই তর্ক-বিতর্ক ফেসবুকেও গড়াতে দেখা যায়। আরশাদুল হক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, উচ্ছেদের প্রতিবাদ করায় তাকে হুমকি ও অপমান করা হয়েছে। জুবায়েরও পাল্টা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, এ অভিযোগ পুরোটাই মিথ্যা নাটক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তাহমিদ হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচিত ছিল সারা দেশের মানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবা, পারলে কাজ করা। সেখানে দেখা গেল ডাকসুর নেতারা 'মাদক ও নিরাপত্তার' অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন।

ঢাবিতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত দোকানপাট বা হকারদের উপস্থিতি অস্বীকার করছেন না এই শিক্ষার্থী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি দেশের সামগ্রিক অবস্থার সঙ্গে বিষয়টিকে মেলাতে বলছেন।

তাহমিদ বলেন, এই ভাসমান মানুষেরা ঋণ করে বা ধারদেনা করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় এসে কিছু করার চেষ্টা করছেন। কেউ আচার বিক্রি করছেন, কেউবা বাদাম কিংবা চা-রুটি বিক্রি করে পেট চালাচ্ছেন। তাদেরকে সহানুভূতির সঙ্গে না দেখে উল্টো দোকান ভেঙে ফেলা, ফুড কার্ট আটকে রাখা, পণ্য নষ্ট করা, এমনকি মারধর করাকে কোনো নৈতিক বা আইনি বৈধতা দেওয়া যায় না।

উচ্ছেদ অভিযানের নামে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব ও দারিদ্রতাকে দেশের বৃহত্তর সমস্যার অংশ হিসেবে না দেখে অত্যন্ত অমানবিকভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে বলে মনে করেন তাহমিদ।

গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ছায়েদুল হক নিশান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি উন্মুক্ত পরিবেশ এবং জনগণের টাকায় এখানকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। সেই জনগণের একটা অংশকে, যারা দরিদ্র এবং জীবিকার সন্ধানে রাস্তায় কর্ম করতে নেমেছেন, ছাত্ররা যদি এভাবে ভয়ানক রূপে তাদের মুখোমুখি হয়, তাহলে তা জাতির জন্য কী বার্তা দেবে? 

ছাত্ররাই একসময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, তাই তাদের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা থাকে বলে মনে করেন এই ছাত্রনেতা। ডাকসু নেতারা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরও উদার হবে, অহিংস এবং গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানবিক মানুষ হোক— এমনটাই চান নিশান।

Comments

The Daily Star  | English
gold price rises in Bangladesh

Gold shines through 2025 amid price volatility

If there were a “metal of the year” award, gold would be a strong contender, maintaining an exceptional run even on the final trading day of 2025..Businesspeople said the retail gold market in Bangladesh has remained unstable over the past few months, driven by fluctuating global prices, s

8m ago