স্বর্ণের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি কিসের ইঙ্গিত, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

দেশে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচবার স্বর্ণের দাম বেড়েছে। সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর ভরিপ্রতি স্বর্ণে দাম এক লাফে সাড়ে চার হাজার টাকা বেড়েছে। এতে প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম প্রায়) ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা ছুঁয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সোনার দামের পাশাপাশি রুপার দামও বাড়ছে।
এ দেশে সাধারণত শীতকালে বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হতে দেখা যায়। বিয়েতে স্বর্ণের অলঙ্কারকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। তাই এই সময়টায় জুয়েলারির দোকানগুলোয় ভালো বেচাকেনা হয়। প্রশ্ন হলো বিয়ের মৌসুমের আগে কেন বাড়ছে স্বর্ণের দাম? এখনই কি স্বর্ণ কেনা উচিত, নাকি দাম কমার জন্য আরও অপেক্ষা করবেন?
দেশে স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছে জুয়েলার্স সমিতি। এখন প্রশ্ন: বিশ্ববাজারে কেন স্বর্ণের দাম বাড়ছে? সহসা কি স্বর্ণের দাম কমার সম্ভাবনা আছে?
গতকাল শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গোটা বিশ্বই এখন এক ধরনের 'স্বর্ণ-জ্বরে' ভুগছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাতে থাকলে এভাবে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে। প্রশ্ন উঠছে—পৃথিবীতে এমন কী ঘটছে যা নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন?
যেকোনো সংকটের সময় বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো মার্কিন ডলারকে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনীতি দশকের পর দশক ধরে এই আস্থা ধরে রেখেছিল। অস্থিরতার সময় বিনিয়োগকারীরা ডলার ও মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কিনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের সেই আস্থায় এখন ফাটল ধরেছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন বলছেন, 'এখন আর সেই দিন নেই। এখন মানুষ স্বর্ণ কেনে।'
দ্রুত স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে। এরই মধ্যে প্রতি আউন্স (২৮.৩৫ গ্রাম প্রায়) স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ২০০ ডলার ছাড়িয়েছে। শুধু স্বর্ণ নয়, রুপার দামও গত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ১৬ অক্টোবর এইচএসবিসি ব্যাংকের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছর প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে।
চীন, ভারত, ব্রাজিল, উজবেকিস্তানসহ কয়েকটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ব্যাপক পরিমাণে স্বর্ণ কিনছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে, সবাই এখন প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প খুঁজছে।
বিশ্বজুড়ে সোনার এই চাহিদার পেছনে কাজ করছে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা।
ডলারের বিকল্প
২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ডলার নিয়ে মানুষের মনোভাবে বড় পরিবর্তন আসে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জি-৭ জোটের দেশগুলো ডলার ও ইউরোতে রাখা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ জব্দ করে। একে বড় সতর্কবার্তা হিসেবে দেখতে শুরু করে অন্য দেশগুলো। পশ্চিমা বলয়ের বাইরের দেশগুলো উপলব্ধি করে যে ডলারে রাখা তাদের রিজার্ভ নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় একে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
এই ঘটনাটি 'ডি-ডলারাইজেশন' বা ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রবণতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর প্রধান বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে স্বর্ণ। কয়েক বছর আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেখানে স্বর্ণ বিক্রি করত, এখন চিত্রটি ঠিক তার উল্টো। এখন বছরে এক হাজার মেট্রিক টনের বেশি সোনা জমা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভল্টে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশ্বজুড়ে ভয় কাজ করছে যে, ডলার তার প্রকৃত মূল্য হারাচ্ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় বিপুল সরকারি খরচ, যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে থাকা সরকারি ঋণ ও সুদের হার কম রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ—এই সবকিছুই ডলারের প্রকৃত মান কমিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করা হয়।
বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস—সরকার চাইলেই যেমন খুশি তেমন টাকা ছাপাতে পারে, কিন্তু তারা স্বর্ণ তৈরি করতে পারে না। এই বিশ্বাসই মূল্যস্ফীতির বিপরীতে স্বর্ণকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে সামনে এনেছে।
ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ
ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ বিশ্বকে এক নাজুক অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই, এ ধরনের অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের চাপে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, 'স্বর্ণ হলো বৈশ্বিক অর্থ-ব্যবস্থার স্বাস্থ্যের হৃৎস্পন্দন মাপার যন্ত্র।' স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার মানে হলো, বিশ্ব অর্থনীতি চরম চাপে আছে। মানুষ চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় ভুগছে এবং এর বিপরীতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিমা হিসেবে সোনাকে বেছে নিচ্ছে।
যেকোনো সম্পদের দাম এভাবে রকেটের গতিতে বাড়লে অর্থনৈতিক 'বুদবুদ'-এর প্রশ্ন আসেই। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা বুদবুদ না-ও হতে পারে। কারণ এবারের এই দৌড়ের পেছনে শুধু ফটকা ব্যবসায়ীরা নন, বরং বিশ্বের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রয়েছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ডলারের আধিপত্য কমা ও ডলারের প্রতি আস্থাহীনতা রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে যাবে না।
তবে দাম কমার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়। হঠাৎ ইউক্রেন নিয়ে শান্তি চুক্তি হলে বা বড় কোনো বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমিত হলে বাজার শান্ত হতে পারে এবং স্বর্ণের দাম সাময়িকভাবে কমতে পারে।
স্বর্ণের আকাশছোঁয়া দাম একটি শক্তিশালী সংকেত। এ থেকে ধারণা করা যায় বিশ্ব ক্রমেই অস্থিরতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সহসা স্বর্ণের দাম পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
এ দিকে চলতি মাসের শুরুতে দেশে স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি বেড়েছে ২১ হাজার টাকা। গত সেপ্টেম্বরে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ভরিতে বেড়েছিল ১৬ হাজার টাকা।
Comments