আকাশ ছুঁয়েছে স্বর্ণের দাম, বদলে যাচ্ছে উপহারের সংস্কৃতি

বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কেনাকাটার জেরে স্বর্ণের দাম আকাশচুম্বী। বাংলাদেশের স্বর্ণ ক্রেতারাও চরম চাপে পড়েছেন। তবু অনেকে এখন বেশি লাভের আশায় এই মূল্যবান ধাতু কিনছেন।

ঢাকার মিরপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী ফারজানা খালিদ তার ভাবীর বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল কিনেছিলেন। উপহারটি ছিল বিশেষ। দাম পড়েছে ৫০ হাজার টাকা।

ফারজানা বলেন, 'দুই বছর আগে একটা ছোট লকেটসহ স্বর্ণের চেইনের দাম ছিল এখনকার তুলনায় অর্ধেক। এখন সেটার দাম প্রায় দ্বিগুণ।'

তিনি বলেন, 'আগে যে টাকায় বড় গহনা কেনা যেত, এখন সেই টাকায় নামমাত্র ছোট্ট গহনা কেনা যায়। ১৩ বছর আগে আমার বিয়েতে আত্মীয়রা ছোট ছোট বেশকিছু স্বর্ণের গহনা উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দাম বেড়ে যে জায়গা পৌঁছেছে, এমন উপহার দেওয়া অনেক কমে গেছে।'

বাংলাদেশে স্বর্ণ শুধু সম্পদই নয়, বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে অপরিহার্য উপহার। কিন্তু এক ভরি স্বর্ণের দাম এখন ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায় পৌঁছেছে, যা ২৬ মাস আগের তুলনায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানায়, দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে ক্রেতার সংখ্যা অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বর্ণের বাজারের চালিকা শক্তি মধ্যবিত্তরা উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে ইতোমধ্যে চাপে থাকায় তারাই এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় জর্জরিত।

বরিশালের শাহাদাত জুয়েলার্সের মালিক শেখ মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'আমাদের দৈনিক বিক্রি ৬০ শতাংশ কমে গেছে। আগে বিয়ে বা উৎসবে স্বর্ণের গহনা উপহার দেওয়া হতো, এখন অনেক কমে গেছে।'

খুলনার আরেক ব্যবসায়ী জানান, তার বিক্রি প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে। অনেকে শুধু জরুরি প্রয়োজন স্বর্ণ কিনছেন।

তিনি বলেন, 'দুর্গাপূজায় অনেকের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু খুব কম মানুষই স্বর্ণ কিনেছেন। অনেকে পুরনো স্বর্ণ দিয়ে গহনা গড়ে নিয়েছেন। অনেকে শুধু ছোট আংটি বা পাতলা চেইন কিনেছেন।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। গত মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্টে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। বাজুসের সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র মাসুদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা আগে ২-৫ হাজার টাকার ছোট গহনা কিনতেন, তারা এখন একেবারেই কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন।'

শ্রীমঙ্গলের একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করা সুকান্ত দাস ২০২৬ সালে বিয়ে করবেন বলে এখন থেকেই সঞ্চয় করছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের সমাজে স্বর্ণ ছাড়া বিয়েটাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়।' তাই তিনি অন্য খরচ কমিয়ে স্বর্ণ কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছেন।

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, বাজারে এখন নতুন গহনার বদলে পুরনো স্বর্ণ বিনিময় বা বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে।

বরিশালের গৃহিণী কবিতা ঘোষ বলেন, 'আগে দুর্গাপূজায় আমরা ছোট স্বর্ণের জিনিস উপহার দিতাম। এখন আর কেউ দেয় না।'

বিশ্ববাজারের অস্থিরতা ও দুর্বল ডলার

বাজুস বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় আমদানি খুবই সামান্য পরিমাণ হলেও স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পেছনে বিশ্ববাজারেরও একটি প্রভাব রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালে স্বর্ণের দাম ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। এর কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি, ইউরোপের ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মার্কিন মুদ্রানীতির অনিশ্চয়তা।

ফরাসি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সোসিয়েতে জেনেরালের বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বাড়ানোয় প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম ৫ হাজার ডলারে পৌঁছানো এখন প্রায় নিশ্চিত।

এই দাম বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ স্বর্ণ ও ডলারের বিপরীত সম্পর্ক। ডলারের মান কমলে সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়ে। ডলারের মান ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়, আর স্বর্ণের দাম ১৯৭০-এর দশকের পর সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ সম্পদে বৈচিত্র্য আনতে ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ২০২২ সাল থেকে তারা প্রতি বছর ১ হাজার টনেরও বেশি স্বর্ণ কিনছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাদে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে ২৯ হাজার ৯৯৮ দশমিক ৪০ টন স্বর্ণ ছিল, যার মূল্য ৩ দশমিক ৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এটি জুলাইয়ের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকা বিদেশি ট্রেজারি বন্ডের মোট মূল্য (৩ দশমিক ৯২ ট্রিলিয়ন ডলার) থেকে সামান্য বেশি।

১০ বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে স্বর্ণের অংশ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, এখন তা ২৪ শতাংশ।

ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও স্বর্ণের গুরুত্ব বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভবিষ্যৎ ঋণ-সংকটের ভয়ে ব্যক্তিগত ক্রেতারাও স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ ভাবছেন। তৃতীয় প্রান্তিকে স্বর্ণভিত্তিক এক্সচেঞ্জ–ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) রেকর্ড ২৬ বিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ এসেছে।

বাংলাদেশের স্বর্ণের রিজার্ভ ১৪ দশমিক ২৮ টন, যেখানে পাকিস্তানের ৬৪ দশমিক ৭৫ টন ও ভারতের ৮৭৯ দশমিক ৯৮ টন।

বাংলাদেশের বাজারের কী অবস্থা?

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও জটিল। কারণ, বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশীয় স্বর্ণের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা থাকলেও শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ৮০ শতাংশই 'পাচারের' মাধ্যমে আসে। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারায় এবং স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক বেশি থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে ২১টি অনুমোদিত আমদানিকারকরা মাত্র ১ টনেরও কম স্বর্ণ আমদানি করেছেন।

বৈধ আমদানি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ব্যাগেজ নীতির মাধ্যমে আনা স্বর্ণই এখন প্রধান সরবরাহের উৎস।

এছাড়া, কোভিড-১৯ মহামারির পর টাকার মান ডলারের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এক ভরি স্বর্ণের দাম প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার টাকা ছাড়ায়। ২০২৩ সালে তা হয় ১ লাখ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৫০ হাজার, এবং এখন ২ লাখ টাকারও বেশি। ২০২৫ সালে দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।

এত দাম বাড়ার পরও অনেকে স্বর্ণ বিক্রি করছেন না।

মাসুদুর রহমান বলেন, 'অনেকে মোবাইল অ্যাপে বিশ্ববাজারে দাম কত সেটা সহজেই দেখতে পারেন। তারা ভাবছেন, আজ ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করলে এক মাস পর ১২ লাখ টাকা পেতে পারেন।' তাই শুধু যারা একেবারে বাধ্য হচ্ছেন, তারাই স্বর্ণ বিক্রি বা বদল করছেন।

তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজুসের পরামর্শ, স্বর্ণের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত করা হলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে।

'অন্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণ আমদানি করে। কিন্তু আমরা পুরনো স্বর্ণ আর ব্যাগেজে আনা স্বর্ণের ওপর নির্ভর করি,' বলেন মাসুদুর রহমান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি স্বর্ণ আমদানি করলে দামের অস্থিরতা কমবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা আসবে।

'গোল্ড কিনেন' নামে একটি স্থানীয় স্টার্টআপের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আতেফ হাসান বলেন, 'স্বর্ণের দামের এই উল্লম্ফন আসলে বিশ্ববাজারের বড় পরিবর্তনের প্রতিফলন।'

তার ভাষায়, 'ইতিহাস আবারও প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে স্বর্ণই সবচেয়ে টেকসই ও নির্ভরযোগ্য সম্পদ।'

তিনি জানান, শুধু ২০২৫ সালেই বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৬ শতাংশ বেড়েছে, যা ধাতুটির প্রতি মানুষের যে বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে সেটি প্রমাণ করে।

তিনি বলেন, গ্রাহকদের মধ্যে স্বর্ণের বার ও কয়েন কেনার আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে, বিশেষ করে তাদের নতুন চালু করা ০.৫ গ্রামের স্বর্ণের বারটি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আতেফ হাসানের মতে, এখন স্বর্ণ শুধু অলংকার নয়, বরং একটি নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু ক্রেতা এখনো ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে এই আশায় গহনা কিনছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণের এই দামের ঊর্ধ্বগতি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের মূল্যই বাড়াচ্ছে না, ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবারগুলোর উপহার দেওয়ার সংস্কৃতিকেও নতুনভাবে গড়ছে।


এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন খুলনা প্রতিনিধি দীপংকর রায় ও বরিশাল প্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষ

ছবিগুলো তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা ও আলোকচিত্রী মোস্তফা সবুজ, আজাহার উদ্দিন, সোহরাব হোসেন ও প্রবীর দাশ

Comments

The Daily Star  | English

Ocean of mourners gather to pay tribute to Khaleda Zia

People from all walks of life arrive by bus, train and other modes of transport

1h ago