সৌদির এফ-৩৫ চুক্তি: উদ্বেগে ইসরায়েল–ভারত, চীনের কৌশলগত সুবিধা বৃদ্ধির আশঙ্কা

সৌদি যুবরাজের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। আর তাতেই তেল আবিব থেকে নয়াদিল্লি পর্যন্ত শুরু হয়েছে কৌশলগত উদ্বেগ।

রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম 'স্টেলথ স্ট্রাইক ফাইটারস' প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান হলো এফ-৩৫। মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিন যুদ্ধবিমানটি তৈরি করে। এর পুরো নাম 'এফ-৩৫ লাইটনিং ২'। কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, এটি বিশ্বের 'সবচেয়ে আধুনিক যুদ্ধবিমান'।

দীর্ঘ সাত বছর পর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছেন। সেখানে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে সৌদি আরবের এই এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি।

ভারতের নিরাপত্তা বিবেচনা ও চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রভাবের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।

মোটা দাগে এটাকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মাঝে সাধারণ অস্ত্র বিক্রি চুক্তি মনে হলেও বাস্তবে তা মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ এক সংযোজন।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ওয়াশিংটন সফরের ঠিক আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন যে যুক্তরাষ্ট্র এই বিক্রির অনুমোদন দেবে। পরে রয়টার্স নিশ্চিত করে, সৌদির অনুরোধে পেন্টাগন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পেরিয়ে গেছে।

এর মাধ্যমে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের মালিক হাতে গোনা যে কয়টি দেশ আছে, তার একটি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে গেল সৌদি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র ইসরায়েল ও এতদিনের বন্ধু ভারতের জন্য এটি কোনোভাবেই স্বস্তির খবর না।

ইসরায়েলের সামরিক প্রাধান্য হারানোর আশঙ্কা

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে এফ-৩৫ এর একমাত্র আঞ্চলিক অধিকারী। ইসরায়েলের 'গুণগত সামরিক প্রাধান্য' বা কিউএমই (কোয়ালিটেটিভ মিলিটারি এজ) নীতি নিশ্চিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় এফ-৩৫ বিক্রিতে কার্পণ্য করেছে। তাই এবারও যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সক্ষমতাসহ নানা বিষয়ে ইসরায়েল পিছিয়ে থাকলেও এতদিন ধরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে তারাই এগিয়ে রয়েছে। সেজন্যই এখন পর্যন্ত কোনও ধরনের যুদ্ধে তাদের 'ব্যর্থতা' নেই। তাদের সতর্কবার্তা হলো, সৌদি আরব এফ-৩৫ পেলে ইসরায়েলের আকাশসীমায় প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব কমতে পারে। স্টেলথ ফিচার, সেন্সর ফিউশন বা মিশন–সিস্টেমের মতো সংবেদনশীল প্রযুক্তি কমিয়ে দিলেও ঝুঁকি থেকেই যাবে।

ইসরায়েলের দুশ্চিন্তা কেবল সক্ষমতার নয়, নজিরেরও। সৌদির পর মিসর, কাতার বা সংযুক্ত আরব আমিরাতও এফ-৩৫ চেয়ে বসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের টিকে থাকা যেখানে প্রযুক্তিগত অগ্রাধিকারের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: রয়টার্স

ভারতের ভয় পর্দার আড়ালে চীনের ছায়া

উদ্বেগ একই হলেও এসব হিসাব-নিকাশ ভারতের জন্য একটু ভিন্ন। নয়াদিল্লির মূল উদ্বেগ সৌদি আরব নয়; বরং এর মাধ্যমে চীন কীভাবে সুবিধা পেয়ে যেতে পারে সেটাই।

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সৌদির সঙ্গে সামরিক সুসম্পর্কের কারণে পাকিস্তান পরোক্ষভাবে এফ-৩৫ এর কিছু কৌশলগত তথ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে।

ভারতের আরও বড় আশঙ্কা হলো, সৌদি–চীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এফ-৩৫ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত চীনের হাতে পৌঁছে দিতে পারে।
ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া জানিয়েছে, চীন–সৌদি যৌথ মিসাইল, ড্রোন ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রকল্পের কারণে এফ-৩৫ প্রযুক্তি 'উচ্চ ঝুঁকিতে' পড়তে পারে। যদি স্টেলথ নকশা বা ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতার সামান্য অংশও বেইজিংয়ের হাতে পৌঁছে যায়, তাহলে সেটা ভারতের নিরাপত্তা সমীকরণকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

চীন ইতোমধ্যেই জে-২০ ও এফসি-৩১/জে-৩১ স্টেলথ জেট দ্রুত উন্নত করছে। এমনকি সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তান চীনা জে-১০ ব্যবহার করে একটি রাফালকেও ভুপাতিত করার দাবি করে বসেছে। পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের এই দাবিকে বিতর্কিত বলে ধরে নিলেও নিঃসন্দেহে তা চীনের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে বহু গুণে।

ভারতের কাছে বিষয়টি তাই শুধু সৌদিকে নিয়ে নয়, বরং চীন–পাকিস্তান–সৌদি আরবের ত্রিভুজ সম্পর্কের এক বৃহত্তর কৌশলগত উদ্বেগে পরিণত হয়েছে।

চীনের নতুন প্রতিযোগিতার সুযোগ

সৌদির কাছে এফ-৩৫ বিক্রির এই চুক্তিকে চীন মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে। ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হলো, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থান শক্তিশালী করা। সেইসঙ্গে চীন বা রাশিয়াকে ভূরাজনৈতিক শূন্যস্থান দখল করতে না দেওয়া।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে চীনের জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে।

চীন ইতোমধ্যেই সৌদি আরবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সুবিধা ও ড্রোন কারখানা স্থাপনে সহযোগিতা করেছে। যদি সৌদির হাতে থাকা এফ-৩৫ এর সামান্য প্রযুক্তিও বেইজিংয়ের কাছে ফাঁস হয়, তবে চীন তাদের স্টেলথ প্রোগ্রাম আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে পারবে। এতে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য বদলে যাবে এবং ভারতের ওপর আরও চাপ তৈরি হবে।

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবের 'ভিশন ২০৩০' ও আধুনিক সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা

সৌদি আরবের কাছে এফ-৩৫ কেবল একটি যুদ্ধবিমান নয়। এটি 'ভিশন ২০৩০'–এর অধীনে সামরিক আধুনিকায়নের একটি ধাপ। দেশটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে পুনর্গঠন করতে চায়।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বলছে, ট্রাম্প এই চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি নিরাপত্তা অংশীদারত্বের প্রমাণ বলেছেন।

কিন্তু সৌদি আরব আটকে আছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মাঝখানে। চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সম্পর্ক যত বাড়ছে, যুক্তরাষ্ট্র ততই কঠোর শর্ত আরোপ করতে পারে। চীনের সম্পৃক্ততা সীমিত করা, যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ঘাঁটিগুলো আরও কঠোরভাবে দেখভালের মতো শর্ত আরোপ করা হতে পারে।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত প্রযুক্তি, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কৌশলগত সম্পর্ক বিস্তার—সবমিলিয়ে সৌদির জন্য পথটি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত সূক্ষ্মও।

এফ-৩৫ সৌদির হাতে পৌঁছাক বা কংগ্রেসে আটকে যাক—এটা স্পষ্ট যে উন্নত অস্ত্র বিস্তারের রাজনীতি নতুন পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। এখনকার পরিস্থিতিতে এফ-৩৫ শুধু একটি যুদ্ধবিমান নয়। এটিকে ঘিরে বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ ও উদ্বেগ জড়িয়ে গেছে।

ইসরায়েল চিন্তিত তাদের সামরিক প্রাধান্য কমে যাওয়া, আর ভারতের ভাবনায় চীন ও পাকিস্তানের কৌশলগত সুবিধা পাওয়া নিয়ে। ওদিকে সৌদির লক্ষ্য নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। মাঝখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব আরও বাড়াতে। অন্যদিকে চীন পরিস্থিতি বুঝে যেকোনো সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুত।

সব মিলিয়ে এফ-৩৫ এখন ওয়াশিংটন, রিয়াদ, তেল আবিব, নয়াদিল্লি ও বেইজিং—এই পাঁচ শক্তিকে ঘিরে নতুন এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Atif Aslam, December, and erasure of historical consciousness

Culture reveals what a society chooses to remember, and what it finds acceptable to forget

35m ago