দুকূলই কি রাখতে পারবেন মোদি?

ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ভারত সফর করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। নয়াদিল্লিতে নেমেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। এই আলিঙ্গন ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেও রাশিয়ার শক্তিশালী মিত্রের অভাব নেই।

কিছুক্ষণ থেমে একটি ঐতিহ্যবাহী নাচ দেখার পর দুজনই একই গাড়িতে ওঠেন এবং মোদির বাসভবনে ব্যক্তিগত নৈশভোজে যোগ দিতে রওনা হন। পুতিনের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেও মোদি রাশিয়ার প্রধান বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কৌশলগত অংশীদারত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।

ভারতের একদিকে উন্নত রাশিয়ান যুদ্ধবিমান কেনার সম্ভাবনা, সস্তা তেল এবং শীতল যুদ্ধ থেকে তৈরি অটুট বন্ধুত্ব; অন্যদিকে প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা—এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শাস্তিমূলক শুল্ক তুলে নেবেন, এই প্রত্যাশা।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়্যার পর ভারত তার বড় বাজার আর ইন্দো-প্যাসিফিকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—দুই দেশকেই নিজের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছে।

যুদ্ধ শুরুর পর পুতিন প্রথমবার ভারত সফর করছেন। তবে এই সফর মোদির জন্য কূটনৈতিকভাবে বেশ কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

অন্যদিকে নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি জরুরি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এর অর্ধেকই ছিল রাশিয়া থেকে সস্তা তেল কেনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতের ওপর সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

ওয়াশিংটনকে সন্তুষ্ট করতে নয়াদিল্লি সম্প্রতি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে—রাশিয়ান তেল কেনা কমিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ লাখ টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) কেনার বিষয়েও সম্মত হয়েছে।

পুতিনের সফরের এই আলোচ্য তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে সম্ভাব্য নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি। ভারত মনে করে, রুশ অস্ত্র কেনা পাকিস্তান ও চীনকে মোকাবিলায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছরে দুই দেশের সঙ্গেই সীমান্ত বিরোধে জড়িয়েছে দেশতি।

আবার রাশিয়া চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আর বেইজিং আবার পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। এই সমীকরণ দেখায় যে ভারত কতটা জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে ।

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ কান্তি বাজপাইয়ের মতে, পুতিনকে এমন জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে নয়াদিল্লি পশ্চিমাদের এবং চীনকে বার্তা দিচ্ছে যে ভারতের সামনে 'বিকল্প রয়েছে'।

তিনি বলেন, 'এটি দেখায় যে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও ভারত রাশিয়ার পাশে থাকতে প্রস্তুত।'

'তেল ও অস্ত্রের বাইরে এটি কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশল—চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দেখানো যে দিল্লির সামনে তৃতীয় পথ আছে, যা আলোচনায় তাদের কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রাখে।'

সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বন্ধুত্ব

স্নায়ুযুদ্ধের সময়ই ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তখন সদ্য স্বাধীন ভারত 'নিরপেক্ষ' নীতি অনুসরণ করলেও দেশ গড়ার পথে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ব্যাপক শিল্প ও অর্থনৈতিক সহায়তা পাচ্ছিল।

তবে রাশিয়ার দিকে ভারতের ঝোঁক স্পষ্ট হয় সত্তরের দশকে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া বাড়াতে থাকে। সেই সময় রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে এবং মস্কো ভারতের জন্য একটি বিশ্বস্ত সামরিক ভারসাম্য রক্ষাকারীর অবস্থান নেয়—যা তারা এখনো ধরে রেখেছে।

গত চার বছরে রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা কমলেও বৈশ্বিক অস্ত্র বিক্রি পর্যবেক্ষণকারী থিংক ট্যাঙ্ক এসআইপিআরআইইয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়াই এখনো ভারতের সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী।

রাশিয়া থেকে যেসব অস্ত্র ভারত কিনেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই কেনা চীনের কথা মাথায় রেখে। আর সেই চীন গত কয়েক বছরে মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছে। অথচ চীনের সঙ্গে ভারতের বহুদিনের সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে।

অন্যদিকে বেইজিং ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, চলতি বছরের শুরুর দিকে সীমান্তে স্বল্পমেয়াদি সংঘর্ষে তারা যে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল, তাতে ব্যবহৃত জেটগুলোর একটি ছিল রাশিয়ার তৈরি সুখোই এসইউ-৩০।

রয়টার্সের তথ্যানুসারে, ভারতের ২৯টি ফাইটার স্কোয়াড্রনের বড় অংশই বর্তমানে রাশিয়ার তৈরি এসইউ-৩০ জেট।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, এ সপ্তাহে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের আলোচনায় রাশিয়ার উন্নততম যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৭ কেনার সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে।

কিন্তু গত কয়েক মাসে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির অর্থনৈতিক সম্পর্ক শিরোনামে এসেছে এবং তা সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেলের দাম পড়ে গেলে ভারত সুযোগটি কাজে লাগায়। দেশের দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতি চালাতে এবং ১৪ কোটি মানুষকে সহায়তা দিতে সস্তা তেল কিনতে আগ্রহী ভারত রাশিয়ার ক্রুড তেল কেনা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায় এবং ক্রেমলিনের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে।

পশ্চিমাদের সমালোচনার জবাবে ভারত বারবার যুক্তি দিয়েছে যে, তার প্রধান কর্তব্য জনগণ ও দেশের অর্থনীতির সুরক্ষা।

তবে আগস্টে ট্রাম্প মেজাজ হারান এবং তিনি ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির জন্য শাস্তি হিসেবে এবং রাশিয়ার তেল কেনার জন্য এই শুল্ক আরোপ করেন তিনি।

এরপর অক্টোবর মাসে ট্রাম্প রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রভাব পড়ে ভারতের বিভিন্ন দপ্তরে।

রফতানি ও তেল পরিশোধন সংস্থাগুলো রয়টার্সকে জানায়, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ডিসেম্বরের তেল আমদানি অন্তত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হবে।

এই সফরের আগে পুতিন প্রশ্ন তোলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও যখন রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করছে, তখন তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর কেন চাপ দেওয়া হচ্ছে।

ওয়াশিংটনের আর্থিক চাপ শুধু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে চাপের মধ্যে ফেলছে না, এটি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নরম হওয়াকেও ত্বরান্বিত করছে।

ট্রাম্পের শুল্ক কার্যকর হওয়ার কয়েক দিন পর মোদি সাত বছর পরে প্রথমবার চীনে সফর করেন। সেখানে শি জিনপিং আয়োজিত সম্মেলনে বেইজিংকে পশ্চিমা সংস্থাগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম বৈশ্বিক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

এই সফরের আগে সেই শীর্ষ সম্মেলনে মোদি ও পুতিনের শেষ সাক্ষাৎ হয়। ক্যামেরার সামনে উজ্জ্বল মুখ নিয়ে তারা হাত মেলান, এরপর জনসাধারণের চোখ থেকে দূরে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট লিমোজিনে বসে এক ঘণ্টার ব্যক্তিগত আলোচনা করেন।

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজপাই বলেন, 'আমার ধারণা, সবাই বুঝতে পেরেছে ভারত সেখানে পশ্চিমাদের কিছুটা এড়ানো বা হালকাভাবে চ্যালেঞ্জ দেখানোর চেষ্টা করেছিল।'

সংবেদনশীল ভারসাম্য

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের প্রশাসন এবং জো বাইডেনের প্রশাসন— দুটিই চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষায় ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। তারা প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ সামরিক মহড়া দিয়ে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে।

মোদিরও ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উভয়ই রক্ষণশীল জনবাহুল্যবাদী নেতা, যারা কূটনৈতিক সম্পর্ককে বড় আকারের অনুষ্ঠান হিসেবে রূপ দিতে পারেন। ভারতীয় নেতা তার প্রথম মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আতিথ্য দিয়েছিলেন এবং হিউস্টনে এক সমাবেশে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রচারণার জন্য কূটনৈতিক প্রোটোকল বাদ দিয়েছিলেন।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি একটি নতুন ১০ বছরের একটি কাঠামো গড়তে সম্মত হয়েছে, যেখানে শিল্প সহযোগিতা, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বাড়ানো হবে। এতে সম্পর্ক কিছুটা মসৃণ হতে পারে, সেই ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।

নয়াদিল্লি এখনো ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগারওয়াল আশা করেন, চুক্তি বছরের শেষ নাগাদ চূড়ান্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের মুখপাত্র জানান, রিক সুইটজারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আগামী সপ্তাহে ভারত সফরে গিয়ে আলোচনায় অংশ নেবে।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব পদক্ষেপ অন্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার ইঙ্গিত দেয় না। নয়াদিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক নন্দন উননিকৃষ্ণ বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চাকাঙ্খী বাণিজ্য চুক্তি করা এবং রাশিয়ার সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রাখা একে অন্যের পরিপন্থী নয়।'

এই আত্মবিশ্বাস ক্রেমলিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণে আরও শক্তিশালী হয়েছে, বলেন বিশ্লেষকরা।

বাজপাই বলেন, 'নয়াদিল্লি ও মস্কোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন জানেন মোদি অনেক চাপে আছেন। তাকে নিজের দেশের জনগণকেও জবাব দিতে হয় এবং তিনি কঠিন অবস্থার মধ্যে আছেন।'

তবুও এই সংবেদনশীল ভারসাম্য ওয়াশিংটনের নজরের মধ্যে থাকবে, বিশেষ করে পুতিনের নয়াদিল্লি সফরের সময় বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় থাকায়।

উননিকৃষ্ণ বলেন, 'ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে যেহেতু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আজকের কঠিন পরিস্থিতিতে আরও কোনো অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করা উচিত নয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Inside a coordinated assault on The Daily Star

Reporter recounts how vandalism, smoke, and security threats shut down the newsroom

43m ago