ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েছে ৮১ শতাংশ

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই, সেই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ। গত বছরের তুলনায় এ বছর সংক্রমণ বেড়েছে ৮১ শতাংশ এবং আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
আগের বছরগুলোর তুলনায় এবারও বেশিরভাগ আক্রান্ত রোগীই ঢাকার বাইরের।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির মধ্যেই গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের তথ্য জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল ১২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টার মধ্যে। এছাড়া আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া তিন জনের মৃত্যুর তথ্য যোগ না হওয়ায় সেই তথ্যও এদিন যোগ করা হয়েছে।
গতকাল নতুন করে ৭৪০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং সংক্রমণ ৭০০ ছাড়িয়ে যায়নি।
ডেঙ্গুতে চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই ৫৭ জন মারা গেছেন। গত মাসে আগস্টে এ সংখ্যা ছিল ৩৯ এবং জুলাইতে ৪১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৭৯ জন মারা গেছেন, যা গত বছরের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। এ সময় পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৪১ হাজার ৮৩১ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৮১ শতাংশ বেশি।
গত বছরের একই সময়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১২৫ জন মারা গিয়েছিল এবং আক্রান্ত হয়েছিল ২৩ হাজার ১০৮ জন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানান, থেমে থেমে বৃষ্টি ও মশকনিধন কার্যক্রম না থাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে। পরিস্থিতি পরিবর্তন না হলে আরও কয়েক সপ্তাহ সংক্রমণ বাড়তে পারে।
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, সাধারণত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে এবার প্রকোপ পিছিয়েছে এবং অক্টোবর মাসে প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হতে পারে আশঙ্কা করেন তিনি।
তিনি কমিউনিটি-ভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর জোর দেন, যার মধ্যে ইনসেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর ট্যাবলেট বিতরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি কেবল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয় মনে করেন তিনি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে সঠিক সেরো-সার্ভেল্যান্স নেই, তাই আমরা সুনির্দিষ্ট কারণ নিশ্চিত করতে পারছি না। তবে যদি ডেন-২ সেরোটাইপটি প্রধান থাকে, তবে রোগের তীব্রতা এবং মৃত্যুর হার বেশি থাকবে।'
সেরো-সার্ভেইল্যান্স হলো রোগ প্রতিরোধক্ষমতার পরিমাণ বোঝার এক ধরনের পরীক্ষা, যা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪।
নাজমুল আহসান বলেন, গত বছর ৭০ শতাংশ ডেঙ্গু সংক্রমণ ডেন-২ স্ট্রেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
এই বছর, বেশিরভাগ রোগী সেকেন্ডারি ডেঙ্গু সংক্রমণে ভুগছেন, যা আরও গুরুতর এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
বয়স্ক ব্যক্তি, অন্তসত্ত্বা নারী ও অন্যান্য সহ-অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মতো উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া ভিন্ন সেরোটাইপের ক্রস-ইনফেকশনের বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন, যা চিকিৎসায় দেরি হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে।
যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার যেমন খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, ভাতের মাড়, স্যুপ এবং ঘরে তৈরি ফলের রস খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নাজমুল আহসান বলেন, জ্বর সেরে যাওয়ার পরের ৪৮ ঘণ্টা সবচেয়ে সংকটজনক সমম। এই সময়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।
দেশে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এখানে ১২ হাজার ১৭০ জন রোগী শনাক্ত এবং ২৭ জন মারা গেছেন।
গতকাল ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১২ জন মধ্যে বরিশাল ও ঢাকায় ৫ জন করে, ময়মনসিংহে ১ জন ও চট্টগ্রামে ১ জন মারা গেছেন।
বরগুনাতে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৬৩১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি এ জেলায় একাধিক মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে, মোট মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন পর্যন্ত ৮৫ জনের মৃত্যু ও ৬ হাজার ৪৫৬ জনের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ এলাকায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু ও ৪ হাজার ৪৭০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
ঢাকায় ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া অনেক রোগীই রাজধানীর বাইরের ছিলেন, যা অন্যান্য বিভাগের তুলনায় শহরের মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকা ও বরিশালের পর চট্টগ্রাম বিভাগেও গত দুই মাসে মৃত্যু ও সংক্রমণ অনেক বেড়েছে। জুলাই পর্যন্ত এখানে ১২ জনের মৃত্যু ও ৩ হাজার ১৩ জন আক্রান্ত হয়েছিল। গতকাল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ মৃত্যু ও ৬ হাজার ৪১২ জনে।
Comments