ট্রাম্পের ২০ দফায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ‘সম্ভাবনা’ কতটুকু?

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনা দেখছে বিশ্ববাসী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের যে ২০ দফা পরিকল্পনা দিয়েছেন তা মেনে নিয়েছে বিবদমান পক্ষগুলো। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব 'সমর্থন' করেন। অন্যদিকে, গাজার শাসক ও প্রধান সশস্ত্র সংগঠন হামাস বলেছে 'শর্ত সাপেক্ষে রাজি'।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাব তো মূলত গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের উদ্যোগ। গাজা যুদ্ধ বন্ধ—এই জোর দাবি প্রতিদিন উচ্চারিত হচ্ছে সিডনি থেকে সিয়াটল পর্যন্ত। কিন্তু, এই চরম নিন্দিত যুদ্ধ বন্ধ হলেই কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে?
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ক্ষমতার জোরে সেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে জ্বলছে মধ্যপ্রাচ্য। এ কথা বিশ্বের শীর্ষ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমজনতা সবারই জানা। সেই মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রকৃত অর্থে শান্তি ফিরিয়ে আনা কি আদতেই সম্ভব?
ক্ষণস্থায়ী হলেও আগে শান্তি আসুক—এমন দাবি গাজাবাসীর। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এমনটিই প্রতিফলিত হচ্ছে। এই আপাত শান্তিকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতে স্থায়ী শান্তির পথে একটু হলেও এগিয়ে যাওয়া যাবে—এমনটিই ভাবছেন বিশ্বের সব শান্তিবাদী মানুষ। তবে থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্নও—গত প্রায় ৮০ বছর ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বে বাস্তুচ্যুত হওয়া ও তাদের অমানবিক নির্যাতনে অকাতরে প্রাণ হারানো ফিলিস্তিনবাসীর জন্য ট্রাম্পের এই 'প্রাথমিক চিকিৎসা' কতটুকু কাজে আসবে?
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলা ফিলিস্তিন সংকট মেটানোর জন্য মার্কিন উদ্যোগেই এর আগে তথা ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ও মাঝামাঝি দুই শান্তিচুক্তি হয়। প্রথম চুক্তিটি সই হয় ১৯৯৩ ও দ্বিতীয়টি হয় ১৯৯৫ সালে। এগুলো 'অসলো শান্তি চুক্তি' হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইৎজাক রাবিন ও ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ও পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত দুই রাষ্ট্রের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে রাজি হলে সারাবিশ্ব তা স্বাগত জানায়। চুক্তি মোতাবেক ১৯৯৯ সালের মে মাসের মধ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শেষ হওয়ার কথা ছিল।

বাস্তবতা হচ্ছে—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জনগণের একাংশের বিরোধিতায় সেই চুক্তি ক্রমাগত গুরুত্ব হারাতে থাকে। বিশেষ করে, ইসরায়েলের উগ্র-ডানপন্থি রাজনীতিক বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি গ্রাস করার উদ্যোগ নিলে 'অসলো চুক্তি' প্রহসনে পরিণত হয়। তবুও তত্ত্বগতভাবে থেকে যায় 'দুই রাষ্ট্র সমাধান'র আশা। ফিলিস্তিনিদের মনে সেই আশা এতটাই প্রবল যে, তারা তা বাস্তবায়নে সশস্ত্র সংগ্রামের পথকেও জিইয়ে রাখে। পাশাপাশি চলতে থাকে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের প্রচেষ্টা।
এখন ২০২৫ সাল। যে সমস্যা সিকি শতাব্দী আগেই সমাধান হওয়া কথা ছিল তা আরও সংকটময় করে তুলতে ইসরায়েল সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর। বিশ্ববাসী দেখেছে—২০০৫ সালে অধিকৃত গাজা থেকে ইসরায়েলকে বিতাড়িত করার পর সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই ধারা এখনো চলছে বলে মনে করেন অনেকে।
শান্তি যখন সুদূর পরাহত সংঘাত তখন অনেক কাছে চলে আসে—এমন দৃশ্যও দেখতে হয়েছে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষদের। দলখদার ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে মরতে দেখে বিশ্ব জনমত 'ইসরায়েলবিরোধী' হয়ে উঠলেও রাজনৈতিক নেতাদের যেন সেদিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ইসরায়েলি সরকারের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সব সীমা লঙ্ঘন করায় ফিলিস্তিনদের নিজস্ব রাষ্ট্রই এখন সংকট সমাধানের একমাত্র উপায়। অর্থাৎ, সেই প্রায় ৩০ বছর আগের 'দুই রাষ্ট্র সমাধান' ব্যবস্থা।
সবাই জানেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা দেশটির সীমানায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল পশ্চিমের মিত্রদের সহায়তায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ গাজাবাসীর ওপর। চালায় সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা।
সেই গণহত্যা বন্ধের উদ্যোগ হিসেবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে পরামর্শ করে ২০ দফা শান্তিচুক্তি প্রকাশ করেন। চুক্তিতে গাজাবাসীর অপার শান্তি ও সমৃদ্ধির কথা বলা হয়। তবে উপেক্ষিত থাকে গণহত্যার প্রসঙ্গ। শুধু তাই নয়, স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথাও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনবাসীর সুদীর্ঘকালের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি অনুপস্থিত ট্রাম্পের এই শান্তি প্রস্তাবে।
ট্রাম্পের ২০ দফা চুক্তির ১৯ দফায় এসে বলা হয়েছে—যতদিন গাজা পুনর্গঠন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সংস্কারের কর্মসূচি চলবে ততদিন ফিলিস্তিনের স্বশাসন ও নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের পথে শর্তগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলবে। শেষ দফায় বলা হয়—পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানের জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ শান্তি প্রস্তাব বিবদমান পক্ষগুলো মেনে নিলেও বাস্তবে তা কতটুকু শান্তি আনবে তা নিয়ে এখনই পরিষ্কার কিছু বলা যাচ্ছে না। ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব প্রকাশের পরদিন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন রাখা হয়—'ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কোন রাষ্ট্রের ভেতরে?'
এই প্রশ্নের জবাব কতটুকু পাওয়া যায় ট্রাম্পের বর্তমান শান্তি পরিকল্পনায়?
Comments