চাটুকারিতা যখন পররাষ্ট্রনীতি

যুদ্ধবিরতি, পুনর্গঠন পরিকল্পনা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী ক্লান্তিকর কূটনীতি—মিসরের অবকাশযাপনকেন্দ্র শারম আল-শেখে আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এগুলোই।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ যখন মাইক্রোফোন হাতে নিলেন, তখন হঠাৎ হাওয়া পাল্টে গেল—গাম্ভীর্য পরিণত হলো নাটকীয়তায়।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন এক নিবন্ধে বলছে, গাজা সংকটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে বিশ্বনেতারা যখন একত্রিত হলেন, তখন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাষ্ট্রনায়কসুলভ বিবৃতির পরিবর্তে পরিণত হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি একগুচ্ছ প্রশংসাবাক্যে।
শেহবাজ ট্রাম্পকে বললেন 'শান্তির পুরুষ', তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার আহ্বান জানালেন এবং দাবি করলেন—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকানোর কৃতিত্ব তারই।
ট্রাম্প তখন মঞ্চে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিলেন, আর চারপাশের নেতারা যেন অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে স্থবির হয়ে ছিলেন। তখন ওই কক্ষের করতালিগুলোকে অনিচ্ছাসূচক মনে হলেও, খবরের শিরোনাম হয় তাৎক্ষণিক।
প্রথাগত কূটনৈতিক মানদণ্ডে বিচার করলে শেহবাজ শরিফের এই বক্তব্য ছিল অতিরঞ্জন। সেই কক্ষে উপস্থিত কোনো নেতাই—না সিসি, না মাখোঁ, না এরদোয়ান—কেউই এই ধরনের অতিরঞ্জিত প্রশংসার আশ্রয় নেননি।
একটি বহুপাক্ষিক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে শেহবাজের মুখে এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছিল নাটকীয়ভাবে অপ্রাসঙ্গিক, প্রায় বিদ্রূপাত্মক। অথচ পরিহাসের বিষয়—এই কৌশল কাজ করেছে, কমপক্ষে সেই একজন দর্শকের ক্ষেত্রে, যিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন: ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বিদ্রূপ নাকি বিরল কৌশল?
যুক্তরাজ্যের রাজস্ব ও কাস্টমসের পরোক্ষ কর নীতি বিভাগে কর্মরত আহমদ সাজ্জাদ মালিক নিবন্ধটিতে লিখেছেন, ট্রাম্প—যার রাজনীতি প্রশংসার ওপর নির্ভরশীল, শেহবাজের বক্তব্য তার জন্য লজ্জাজনক ছিল না, বরং ছিল প্রেরণাদায়ক।
ট্রাম্পের বিনিময়-ভিত্তিক কূটনীতির নাট্যমঞ্চে চাটুকারিতা প্রতারণা নয়, বরং এক ধরনের মুদ্রা। অতিরঞ্জিত প্রশংসার একটি বাক্য নীতিনির্ধারণী একটি অনুচ্ছেদের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আত্মমুগ্ধ ব্যক্তির কানে ভক্তিই হয়ে ওঠে কূটনৈতিক ভাষা।
রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন 'নার্সিসিস্টিক রিওয়ার্ড লুপ'—এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া, যেখানে প্রশংসা সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করে তোলে, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব যাই হোক না কেন।
সেই মুহূর্তে শেহবাজ শরিফ হয়তো পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নিতে পারেননি, কিন্তু তিনি একটি শক্তিশালী কাজ করেছেন: নিজেকে এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে ট্রাম্পের 'শান্তি'-বিষয়ক বিবৃতির অংশ করে তুলেছেন। বক্তৃতার অস্বাভাবিকতাই হয়ে উঠেছে তার কার্যকারিতার মাধ্যম।
মিশরে যা ঘটেছে, তা বক্তব্য তত্ত্ব অনুযায়ী ছিল একটি 'পারলোকিউশনারি মিসফায়ার'—অর্থাৎ, একটি বক্তব্য যেটি বক্তার উদ্দেশ্যের চেয়ে ভিন্ন প্রভাব ফেলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে।
শেহবাজ শরিফ সম্ভবত ট্রাম্পকে খুশি করতে কিংবা নেতাদের ভিড়ে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হয়ে উঠলেন আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চের এক কেন্দ্রবিন্দু—যা সমালোচকদের বিদ্রূপের বিষয় হলেও ট্রাম্পের দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠলো।
বাকি বিশ্ব যেটিকে দেখল অসমীচীন কাজ হিসেবে, ট্রাম্প সেটিকে দেখলেন একনিষ্ঠ অনুরাগ হিসেবে। আর আত্মকেন্দ্রিক কূটনীতির অসম দুনিয়ায় এই পার্থক্যই হয়ে ওঠে সবকিছু।
যখন বক্তব্যের অর্থ অন্যদিকে গেলেও ফলাফল ইতিবাচক হয়—এই প্রবণতা জনসংযোগ তত্ত্বে পরিচিত 'বেনিফিশিয়াল মিসইন্টারপ্রিটেশন' নামে। বক্তার উদ্দেশ্য ও শ্রোতার গ্রহণভঙ্গি ভিন্ন হয়, কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝিই বক্তার উপস্থিতি বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। এই মিডিয়া-সন্তৃপ্ত যুগে এটিই হলো ভুল যোগাযোগের মধ্য দিয়ে অর্জিত অদ্ভুত সফলতা।
শেহবাজ শরিফের এই বক্তৃতা হয়তো নীতিনির্ধারকদের মন জয় করতে পারেনি, কিন্তু তা শিরোনাম দখল করেছে, বিশেষত প্রতিবেশী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এবং একটি শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানকে কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দিয়েছে—যা মূলত ছিল গাজার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও মিশরের নেতৃত্বে পরিচালিত।
অনেক পর্যবেক্ষকের চোখে এটি ছিল অপমানজনক: একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি রিয়েলিটি-টিভি ধাঁচের এক প্রেসিডেন্টকে তোষামোদ করছেন।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা নাকি দৃশ্যপট নির্মাণের মঞ্চ?
কিন্তু রাজনীতি, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর মিডিয়া-ভিত্তিক রাজনীতি পুরনো সৌজন্যবোধের নিয়ম মেনে চলে না। অভিপ্রায় নয়, এখন গুরুত্ব পায় প্রভাব।
ট্রাম্প—যিনি আদর্শের চেয়ে আত্ম-ভাবমূর্তিতে বেশি মনোযোগী, প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন রাষ্ট্রনায়কের মতো নয়, বরং একজন সেলিব্রিটির মতো, যিনি প্রশংসায় ভেসে আনন্দ পান।
তিনি হাসলেন, রসিকতা করলেন এবং বললেন— আর কিছু বলার দরকার নেই। বিশ্ব হাসল—কিন্তু ট্রাম্প শুনলেন।
এখানেই লুকিয়ে আছে এই কাহিনীর বৈপরীত্য। যে অস্বাভাবিক আচরণ শেহবাজ শরিফকে ঐতিহ্যবাহী কূটনীতিকদের থেকে আলাদা করেছিল, সেটাই তাকে (যদিও সাময়িকভাবে) ট্রাম্পের কাছে টেনে নেয়।
একদিকে যা ছিল কূটনৈতিক ভুল, অন্যদিকে মনোবৈজ্ঞানিকভাবে তা ছিল নিখুঁত এক পদক্ষেপ—এক আত্মমগ্ন মননের প্রতি প্রশংসার সুনিপুণ আহ্বান।
কলামিস্ট আহমদ সাজ্জাদ মালিক ডনে লিখেছেন, এই ঘটনাটি আজকের যুগের অভিনয়-ভিত্তিক কূটনীতি নিয়ে আরও বড় এক সত্যকে উন্মোচন করে। আধুনিক সম্মেলনগুলো এখন আর শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা নয়, বরং দৃশ্যপট নির্মাণের মঞ্চ।
নেতারা একে অপরের সঙ্গে যত না কথা বলেন, তারচেয়ে বেশি চান পরিচিতি। চাটুকারিতা, যা একসময় ছিল সূক্ষ্ম কূটনৈতিক কৌশল, এখন হয়ে উঠেছে আত্মপ্রচারের হাতিয়ার।
এই বাস্তবতায়, এমনকি এমন একটি বক্তৃতাও (যা বিশ্বকে চমকে দেয়) উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে—যদি তা শিরোনাম দখল করে এবং নজর কাড়ে। বাস্তব বিষয়বস্তু এখন জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে নাটকীয়তাকে; কূটনীতি হয়ে উঠছে মঞ্চনাট্য।
শারম আল-শেখে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজের কথাগুলো গাজার পুনর্গঠনের পথ বাতলে দেবে না, কিংবা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিও পুনর্লিখন করবে না। কিন্তু এগুলো আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যাকরণ কীভাবে বদলে যাচ্ছে—যেখানে অস্বাভাবিকতা হতে পারে কার্যকর, আর ভুল পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে মিডিয়া কৌশল।
ক্লাসিক সংজ্ঞায়, এটি কূটনীতি ছিল না; বরং একটি কেস স্টাডি হতে পারে—যেখানে চাটুকারিতা এক আত্মমগ্ন ব্যক্তির দৃষ্টিতে পড়ে, তখন তা দুর্বলতা নয় বরং হয়ে ওঠে এক ধরনের প্রভাবের অস্ত্র।
সেই সম্মেলনের কক্ষে গুঞ্জন চলছিল, কূটনীতিকরা ফিসফিস করছিলেন, সামাজিকমাধ্যমে উপহাস চলছিল। কিন্তু একজন ব্যক্তি (ট্রাম্প) হাসছিলেন। আর ভূরাজনীতির খেলায়, কখনো কখনো এক ব্যক্তির করতালিই পুরো দুনিয়ার উপহাসের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
Comments