নেতানিয়াহু কেন প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাইলেন

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলমান দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে অবশেষে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

আজ রোববার প্রেসিডেন্ট হার্জগের কার্যালয় এক বিবৃতিতে ক্ষমা চেয়ে নেতানিয়াহুর চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। 

সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বিবৃতি তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, 'এটি একটি বিশেষ অনুরোধ এবং এর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় অবগত আছে। এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মতামত পাওয়ার পর অনুরোধটি বিবেচনা করবেন প্রেসিডেন্ট।'

ঘুষ, জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে ২০১৯ সালে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিনটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। পরের বছর বিচার কাজ শুরু হয়, যা এখনো চলমান। 
বরাবরই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন নেতানিয়াহু। তার দাবি, গণমাধ্যম ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি।

চিঠিতে নেতানিয়াহু লিখেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জনগণের মধ্যে বিভক্তি দূর করা আমার দায়িত্ব। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলেই একে ঘিরে জন্ম নেওয়া বিতর্ক ও উত্তেজনার তীব্রতা কমবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।'

তিনি আরও লিখেছেন, 'ইসরায়েল এই মুহূর্তে যে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এই ফাটল দূর করে জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় আস্থা পুনরুদ্ধারে আমি আমার ক্ষমতায় যা করা সম্ভব সবকিছু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

একটি ভিডিও বিবৃতিও দেন নেতানিয়াহু। সেখানে, সপ্তাহে তিনবার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে তার পক্ষে দেশ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন।

ক্ষমা পেলে দেশের কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন বলে মনে করছেন নেতানিয়াহু।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমার অনুরোধ জানিয়ে দুটি চিঠি লিখেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে একটি বিশদ, যেখানে তার আইনজীবীর সই রয়েছে। অন্যটিতে নেতানিয়াহুর সই।

চিঠি দুটি মতামতের জন্য প্রথমে বিচার বিভাগে এবং পরে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের আইন উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে। 

সিদ্ধান্ত নিতে প্রেসিডেন্টের সুবিধার্থে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। 

নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ইতিহাসে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজ দেশেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।

নেতানিয়াহুর মামলা ঘিরে জনবিভক্তি

বিচারের কাঠগড়ায় সবাই সমান। একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পার্থক্য নেই—ইসরায়েলের গণতন্ত্রের এমন শক্তিশালী ভিত্তিকে রীতিমত হুমকির মুখে ফেলেছেন নেতানিয়াহু।

২০২২ সালে কট্টর ডানপন্থি জোটকে নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের বিচার ব্যবস্থা সংশোধনে বিতর্কিত নতুন সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা এবং গাজা যুদ্ধের অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে সাক্ষ্য গ্রহণ স্থগিতের অনুরোধ-দেশটির গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- এমনটা মনে করেন দেশটির প্রগতিশীল মুক্তমনা জনগণ।

এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর মার্চে সংস্কার বাতিল ও নেতানিয়াহুর বিচারের দাবিতে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ করে জনগণ। ১০ সপ্তাহব্যাপী ওই বিক্ষোভের তোড়ে শেষ পর্যন্ত সংস্কার পরিকল্পনা বাতিল করেন নেতানিয়াহু।

প্রায় ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় নেতানিয়াহু ও তার লিকুদ পার্টি। টিকে থাকতে এখন তারা কট্টর জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় জোটকে প্রাধান্য দিচ্ছে, যা দেশটির জনগণের মধ্যে বিভক্ত ও সাংস্কৃতিক লড়াই তীব্র করছে।

ট্রাম্পের অনুরোধ

বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুকে এই আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচাতে শুরু থেকেই ঢাল হয়ে পাশে আছেন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নেতানিয়াহুর মতো ট্রাম্পও এই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করেন।

ক্ষমা করতে ইতোমধ্যে কয়েকবার ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হার্জগকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছেন ট্রাম্প। অক্টোবরে ইসরায়েল সফরের সময় দেশটির পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে একই অনুরোধ জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। 

সমালোচকদের মতে, গাজায় গত দুই বছর ধরে চলমান হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংকের আর্থিক সহায়তা, সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝা আর চালাতে রাজি নন ট্রাম্প। শান্তি পরিকল্পনা কার্যকর করতে নেতানিয়াহুর ওপরই ভরসা করছেন তিনি।   

ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিঙ্কাস মনে করেন, ওয়াশিংটনের চাপেই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে হয়েছে নেতানিয়াহুকে।

এর আগে গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিকে তিন হাজার বছরের প্রস্তুতির ফল এবং এটি টিকে থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন ট্রাম্প। 

কী আছে দুর্নীতির তিন মামলায়

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিন মামলা মূলত 'কেস ১০০০', 'কেস ২০০০' এবং 'কেস ৪০০০' নামে পরিচিত। 

'কেস ১০০০' 

এটি উপহার বিষয়ক মামলা। মামলায় নেতানিয়াহু ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ধনী ব্যবসায়ী হলিউড চলচ্চিত্র প্রযোজক আর্নন মিলচান এবং অস্ট্রেলীয় বিলিওনিয়ার জেমস প্যাকারের কাছ থেকে অবৈধভাবে প্রায় ২ লাখ ডলারের উপহার নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিনিময়ে মার্কিন ভিসার মেয়াদ বাড়ানোসহ ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। 

'কেস ২০০০'

'ইয়েদিওথ আহরোনোথ' নামের ইসরায়েলের সর্বাধিক বিক্রিত সংবাদপত্রের প্রকাশক আর্নন মোজেসের সঙ্গে গোপন চুক্তির চেষ্টার অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। 

চুক্তি অনুযায়ী, নেতানিয়াহুকে নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের বিনিময়ে পত্রিকাটির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী 'ইসরায়েল হায়োম'-এর প্রচার কমিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।

'কেস ৪০০০' 

বেজেক-ওয়ালা মামলা নেতানিয়াহু যোগাযোগমন্ত্রী থাকার সময়কালে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে করা হয়েছিল। ইসরায়েলের বৃহত্তম টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি 'বেজেক'-এর মালিক শাউল এলোভিচকে কোটি কোটি ডলারের নিয়ন্ত্রক সুবিধা দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। 

বিনিময়ে এলোভিচের মালিকানাধীন সংবাদ ওয়েবসাইট 'ওয়ালা'তে নেতানিয়াহুকে নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করা হতো।

দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল হতে পারে নেতানিয়াহুর। 

ইসরায়েলে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক হলেও দোষী সাব্যস্ত যেকোনো অপরাধীকে ক্ষমা করার ক্ষমতা রয়েছে। 

নিজ দেশে ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা রয়েছে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। 

গত বছর নভেম্বরে নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করে আইসিসি।

Comments