হারিয়ে যাচ্ছে দজলা নদী!
বাংলার পাঠকের কাছে 'দজলা' ও 'ফোরাত' সুপরিচিত নাম। বিশ্ববাসীর কাছেও এই দুই নদী সুবিদিত—সুপ্রাচীন কাল থেকেই। প্রাচীন বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখা এই নদী দুটি দীর্ঘপথ এঁকে অপরের পাশাপাশি বয়ে চলেছে। যেন যমজ বা মানিকজোড়—দুই সহোদর।
প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি আজকের ইরাকের পুরোনো নাম 'মেসোপটেমিয়া' এসেছে এই দুই নদীকে ঘিরেই। গ্রিক ভাষায় 'মেসোপটেমিয়া' অর্থ দুই 'নদীর মধ্যবর্তী স্থান'। অর্থাৎ, দজলা ও ফোরাতের মাঝখানের জায়গা।
বিশ্বখ্যাত এই নদী দুটির উৎস তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে। প্রায় ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে। তুরস্কে জন্ম নিয়ে ফোরাত আজকের সিরিয়ার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ইরাকে ঢুকেছে। আর তুরস্ক থেকে নেমে দজলা ইরাকের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দেশটির দক্ষিণে বসরা অঞ্চলে ফোরাতের সঙ্গে মিশেছে।
এই দুই নদী একত্রিত হয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার 'শাত আল-আরব' নামে বয়ে চলেছে। এরপর প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে ইরাকের সীমানা তৈরি করে নদীটি পড়েছে পারস্য উপসাগরে।
এটিই এই দুই গুরুত্বপূর্ণ নদীর দীর্ঘ প্রবাহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তবে আজকের আলোচনা দজলাকে নিয়ে।
সংকটে সভ্যতার আঁতুড়ঘর
ব্রিটানিকা বলছে—দজলা নদীর সুমেরীয় নাম 'ইদিগনা'। আক্কাদীয় নাম 'ইদিকলাত'। বাইবেলে এই নদীর নাম বলা হয়েছে 'হিদ্দেকেল'। গ্রিকরা একে ডাকে 'তাইগ্রিস' নামে। এই নামটিই পরে বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রায় ১৯শ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই তাইগ্রিসকে আরবরা ডাকে 'দিজলাহ' বলে। বাংলায় তা হয়েছে 'দজলা'।
একইভাবে ফোরাতেরও আছে জাতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম। তবে এই দুই নদীকে সম্মিলিতভাবে বলা হয় 'প্রাচীন সভ্যতার জন্মদাত্রী'। কেউ বলেন, 'সভ্যতার আঁতুড়ঘর'। আবার কারো কাছে 'জীবনদাতা'।
আজকের ইরাকবাসীর কাছে এই 'জীবনদাতা' শব্দটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গত ১৬ ডিসেম্বর ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক শিরোনামে বলা হয়—'পানি নেই তো জীবনও নেই'। আরও গভীর আশঙ্কার কথাও তুলে ধরা হয় শিরোনামটিতে। বলা হয়—এই নদী হারিয়ে যেতে বসেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে—দ্রুত জরুরি ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই নদীর তীরে সুপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনধারা আমূল বদলে যাবে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রকাশিত দজলা নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—পূর্ব তুরস্কের পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম দিয়ে সেখানকার পাহাড়ি পথ বেয়ে দজলা নেমে এসেছে ইরাকের সমভূমিতে। নদী তীরবর্তী জনগোষ্ঠীগুলোর মিঠা পানির প্রয়োজন মেটানোর একমাত্র উৎস এই দজলা। কৃষিকাজেও এই নদীই প্রধান ভরসা।
এতে আরও বলা হয়—ইরাকে দীর্ঘ খরার কারণে দজলার পানি দিয়েই মেটানো হয় বিস্তৃত অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর চাহিদা। শুধু তাই নয়, দজলার ওপর একের পর এক বাঁধ দিয়ে ক্রমবর্ধমান সেচের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। আর এসবের প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর।
চরম দুর্দশায় ঐতিহাসিক দজলা
ব্রিটানিকা থেকে আরও জানা যায়, প্রাচীন আসিরীয় সভ্যতার (খৃষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর) তিন রাজধানীর মধ্যে দুটিই গড়ে উঠেছিল দজলার তীরে। এমনকি, আজকের ইরাকের রাজধানী বাগদাদও বিকশিত হয়েছে এই নদীকে ঘিরে। যুগে যুগে এই নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধে বাঁধে বাধাগ্রস্ত হয়ে এই নদী এখন মরণদশায়।
২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দজলা নিয়ে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি সেই নদী যা বাইবেলে উল্লেখ করা বাগানের (গার্ডেন অব ইডেন) পানিরও উৎস ছিল। এই নদীই জন্ম দিয়েছে মানবসভ্যতা।
কিন্তু, আজ সেই দজলাই মরতে বসেছে।
দজলার এই দুরবস্থা শুধু ইরাকবাসীর জন্য মাথাব্যথার কারণ নয়। এটি বিশ্ববাসীর জন্যও উদ্বেগের। প্রতিবেদন অনুসারে, মানুষের প্রকৃতিবিরোধী কাজ ও জলবায়ু পরিবর্তন এক সময়ের প্রমত্তা দজলার গলা টিপে ধরেছে।
আজকের ইরাক খনিজ তেলে সমৃদ্ধ হলেও দেশটির পরিবেশ বহু বছরের যুদ্ধ, বৃক্ষনিধন ও প্রলম্বিত খরায় জর্জরিত। কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার শেষ চিহ্নটুকুও আজ বিলীন হওয়ার পথে। জাতিসংঘ বলছে—একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এই নদী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষী।
এই দজলাকে ইরাকি শহর মসুল, রাজধানী বাগদাদ ও বন্দরনগরী বসরার 'জীবনদাত্রী' হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, 'নদীর উজানে বিশেষ করে তুরস্কে অধিকাংশ বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রমবর্ধমান খরা।'
তুরস্কের বিরুদ্ধে দজলার ওপর বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনে ইরাকের কেন্দ্রীয় ও কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকার বলছে, এ কারণে নদীর ভাটি এলাকায় পানির প্রবাহ ভয়াবহ পরিমাণে কমে গেছে।
সে বছর ইরাকি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—তুরস্ক থেকে ইরাকে ঢোকার পর দজলার গড় প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।
দজলার পানি বেশি বেশি করে ছাড়ার জন্য বাগদাদ থেকে আঙ্কারাকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করা হলেও তুরস্কের বক্তব্য, 'ইরাকের উচিত তারা যে পরিমাণ পানি পাচ্ছে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা।' ইরাকে পানির অপচয় হয় বলে সে বছর জুলাইয়ে টুইট করেছিলেন বাগদাদে তুরস্কের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত।
সে বছর চরম খরায় নদীর পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। সেচের পানির অভাবে ইরাকে চাষাবাদের জমি অর্ধেক কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য, '২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে ইরাকে মিঠা পানির প্রাপ্যতা ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে।'
সে বছর বাগদাদে দজলার কয়েকটি অংশ শুকিয়ে যাওয়ায় অনেকে নদীর মাঝখানে ভলিবল খেলেছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি থাকায় সেখানে অনেকে জলকেলি করেছিল। ইরাকের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য—পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে।
২০২৩ সালের ১ আগস্ট বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আজ থেকে প্রায় ৮ হাজার বছর আগে শিকারি মানুষ দজলা-ফোরাতের মধ্যবর্তী জায়গায় বসতি করেছিল। সেখানে তারা কৃষির উন্নয়ন ঘটায়। গড়ে তোলে সভ্যতা। তারা চাকা ও লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। আইনি ব্যবস্থা ও নৌকা চালানোর পাশাপাশি তারা সংগীতের বিকাশ ঘটায়। তাদের আবিষ্কারের তালিকা আরও দীর্ঘ বলে মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদরা।
'এইখানে এক নদী ছিল'
আবার ফিরে আসা যাক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনটিতে। ইরাকের এক প্রাচীন ধর্মমতের গুরু ৬৮ বছর বয়সী শেখ নিদহাম ক্রেইদি আল সাবাহি সংবাদমাধ্যমটিকে জানান, তার বিশ্বাস দজলার পানি পান করে তিনি এতগুলো বছর সুস্থ আছেন। তিনি আরও বিশ্বাস করেন, যতদিন এই নদী প্রবাহিত হবে, ততদিন এর পানি পরিষ্কার থাকবে।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে—দ্রুত এই নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে একদিন এর প্রবাহ পুরোপুরি থেমে যাবে। এই বিশ্বখ্যাত নদীর পানি কোথাও কোথাও ভীষণভাবে দূষিত হয়ে গেছে।
ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আমারাহর অধিবাসী শেখ নিদহাম বাস করে দজলার তীরে। তার বয়স যখন এক মাস ছিল তখন থেকে তিনি এই নদীতে নিয়মিত গোসল করে আসছেন। গণমাধ্যমটিকে তিনি বলেন, 'পানি নেই তো জীবনও নেই।'
আমারহ শহর গড়ে উঠেছে দজলাকে ঘিরেই। শেখ নিদহামের ধর্ম মতে, পানি তাদের ধর্মবিশ্বাসের অংশ। পানি পবিত্রতার প্রতীক। তাই প্রতিটি সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। তার ধর্মবিশ্বাসের মানুষেরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তার মতে, 'বাতাসের মতোই পানি গুরুত্বপূর্ণ। পানি না থাকলে অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।'
প্রতিবেদন অনুসারে—আজো দজলার পানি সেচ, নৌ চলাচল, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তীরবর্তী প্রায় ২ কোটি মানুষের জন্য এই নদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দজলা রক্ষায় কাজ করা প্রতিষ্ঠান হুমাত দিজলাহর প্রতিষ্ঠাতা সালমান খাইরাল্লাহ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, 'সব ইরাকির জীবন পানির ওপর নির্ভরশীল। সব সভ্যতা ও যত গল্প আপনি শুনবেন তা এই দুই নদীকে ঘিরেই। এই পানি শুধু পান বা সেচের কাজে ব্যবহারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এসবের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।'
সংবাদ সংস্থা এএফপির কয়েকটি ছবিতে দেখা গেল—কোথাও কোথাও দজলা পরিণত হয়েছে খানা-খন্দকে। কোথাও শুকিয়ে চৌচির। কোথাও বা দেখে বোঝার উপায় নেই—এখানে কোনো একদিন কোনো একটা প্রমত্তা নদীর প্রবাহ ছিল।
হয়তো অনেক পাঠকের মনে পড়বে—বাংলার সেই জনপ্রিয় গানটির কথা—'আমার একটা নদী ছিল/জানলো নাতো কেউ।'


Comments