ভয়ভীতি-সহিংসতায় মানুষকে ভোট দিতে বাধ্য করছে মিয়ানমারের জান্তা: জাতিসংঘ

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রধান ফলকার টুর্ক। ফাইল ছবি: এএফপি
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন প্রধান ফলকার টুর্ক। ফাইল ছবি: এএফপি

জাতিসংঘ দাবি করেছে, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দেশটির নাগরিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করছে।

এই উদ্দেশ্য পূরণে সহিংসতা ও ভয়ভীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর সরকার। এমনটাই দাবি করেছে জাতিসংঘ।

গত মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।

অপরদিকে, মানুষ যাতে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে এই 'প্রহসনমূলক' নির্বাচনে অংশ না নেয়, তা নিশ্চিত করতে সরকার বিরোধী পক্ষগুলোও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এবং সেগুলোও সহিংসতামুক্ত নয়। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক এক বিবৃতিতে বলেন, 'মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ ভয়াবহ সহিংসতার মাধ্যমে মানুষকে ভোট দিতে বাধ্য করছে এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের গ্রেপ্তার করছে। এটা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে।'

আগামী রোববার থেকে জান্তার অধীনে প্রথম নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, বিশ্লেষকদের মতে এর অনেক 'সীমাবদ্ধতা' রয়েছে।

পাঁচ বছর আগে নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।

সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান অং সান সু চি। ফাইল ছবি: এএফপি (২০১৫)
সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান অং সান সু চি। ফাইল ছবি: এএফপি (২০১৫)

ওই ঘটনার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মিয়ানমার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তা রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। হতাহত ও বাস্তুচ্যুত হন হাজারো মানুষ।

এখনো সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধান বেসামরিক নেতা অং সাং সু চি কারাবন্দী আছেন। তার জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলটিকেও সরকারি আদেশে বিলুপ্ত করা হয়েছে।

টানা এক দশক গণতন্ত্র চালু থাকার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসনে ফিরে যায় মিয়ানমার।

মিয়ানমারে এক মাস ধরে নির্বাচন হবে। এর বেশ কয়েকটি ধাপ থাকছে। তা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা একে বৈধতা দেননি। তাদের মতে, এটি সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ ছাড়া আর কিছুই না।

গত মাসে এএফপিকে ফলকার টুর্ক বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে নির্বাচন আয়োজন 'অকল্পনীয়'। মঙ্গলবার তিনি হুশিয়ার করেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং সশস্ত্র বিরোধী পক্ষ উভয়ই বেসামরিক মানুষদের ভোট দিতে বা না দিতে হুমকি দিচ্ছে।

বক্তব্যে তিনি আরও উল্লেখ করেন, বেশ কয়েক ডজন মানুষকে 'নির্বাচন সুরক্ষা আইনের আওতায়' গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আদতে গ্রেপ্তারকৃতরা শুধু তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করছিলেন।

তাদের অনেকেই 'অত্যন্ত কঠোর শাস্তি' পেয়েছেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

ইয়ানগন অঞ্চলের হ্লাইংহায়া গ্রামের তিন তরুণের শাস্তির উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, শুধু 'নির্বাচন-বিরোধী পোস্টার' সাঁটানোর অভিযোগে তাদেরকে ৪২ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় আরও জানায়, তারা মিয়ানমারের মান্দালায়সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের বাস্তুচ্যুত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, তারা ভোট দেওয়ার জন্য নিজ অঞ্চলে ফিরে না গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো বা বাড়িঘর জব্দ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। 

টুর্ক বলেন, 'পরিস্থিতি নিরাপদ না থাকা সত্ত্বেও, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাস্তুচ্যুত মানুষকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।'

তিনি আরও দাবি করেন, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধচারণকারী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকেও 'গুরুতর হুমকি' পাচ্ছেন বেসামরিক মানুষ।

ভোট সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিতে যাওয়া নয় নারী শিক্ষিকাকে গত মাসে কিয়াক্টো থেকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানান টুর্ক।

পরবর্তীতে তাদেরকে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত না থাকার বিষয়ে সতর্ক করে মুক্তি দেওয়া হয়।

মিয়ানমারে নির্বাচণী প্রচারণা। ছবি: এএফপি
মিয়ানমারে নির্বাচণী প্রচারণা। ছবি: এএফপি

ইয়ানগন অঞ্চলের হ্লেগু ও নর্থ ওক্কালাপা গ্রামের প্রশাসনিক ভবনগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে স্বঘোষিত ইয়ানগন আর্মি। এসব হামলায় বেশ কয়েকজন নির্বাচন কর্মী আহত হয়েছেন। সশস্ত্র সংগঠনটি নির্বাচন আয়োজকদের ওপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে।  

টুর্ক এ প্রসঙ্গে বলেন, 'স্পষ্টতই, এই নির্বাচন সহিংস ও শোষণমূলক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।'

'স্বাধীন মত প্রকাশ, সমবেত হওয়া বা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি সেখানে নেই, যা (নির্বাচনে) মানুষের মুক্ত ও অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে', যোগ করেন তিনি।

Comments