কোঁকড়া চুলই এখন ট্রেন্ড, যত্ন নেবেন যেভাবে
কোঁকড়া চুল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন এই চুল সামলানো কঠিন, দেখতে ভালো লাগে না, আর এর যত্ন নেওয়াও ভীষণ ঝামেলাপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। এসব ধারণার কারণে কোঁকড়া চুল নিয়ে অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারান। কিন্তু আর নয়—সময় এসেছে এসব ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলে নিজের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার।
কাজরিয়া কায়েস বাংলাদেশের কোঁকড়া চুলের নারীদের কাছে একটি পরিচিত নাম। একসময় বিভিন্ন উপলক্ষ্যে নিজের চুল স্ট্রেইট করাতেই বেশি অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি সিজিএম (কার্লি গার্ল মেথড) সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এ নিয়ে বিশদ ঘাঁটাঘাঁটি করার পরে, কোঁকড়া চুল সুন্দরভাবে সামলানোর বিষয়টিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের কোঁকড়া চুলের নারীদের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয় তার হাত ধরেই। ফেসবুকে তিনি 'কার্লি গার্ল বাংলাদেশ বাই কাজরিয়া কে' এবং ইনস্টাগ্রামে 'দ্য কার্ল স্টেশন' নামে সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করেন এবং এই সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন—কীভাবে খুব সহজেই কোঁকড়া চুল সামলানো ও যত্ন নেওয়া যায়।
কাজরিয়া বলেন, 'সিজিএম (কার্লি গার্ল মেথড) নিয়ে অনেকেরই ধারণা যে এটি খুব ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু গত আট বছর ধরে নিয়মিত গবেষণা ও চর্চার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি—বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। বরং এটি নারীদের পাশাপাশি অল্পবয়সী, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য ও কার্যকর।'
সিজিএম অনুসরণ করতে হলে প্রথমেই আপনাকে নিজের চুলের ধরন সম্পর্কে জানতে হবে। চুল হতে পারে ঢেউ খেলানো, সাধারণ কোঁকড়া বা ঘন ও টাইট কোঁকড়া, যা ২এ থেকে ৪সি পর্যন্ত বিভিন্ন টাইপে ভাগ করা হয়েছে। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, টাইপ ৪সি চুলের জন্য এই পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কিন্তু এতে অন্যদের নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাস্তবে দেখা গেছে, টাইপ ২এ থেকে ৪এ পর্যন্ত চুলের নারীরাও এই মেথড ব্যবহার করে চুল সুন্দরভাবে সামলাতে সক্ষম হয়েছেন।
কাজরিয়া বলেন, এই মেথডে কোঁকড়া চুলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এমন সব কেমিক্যাল ও পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, চুল শুকানোর জন্য ব্যবহৃত সালফেট, সিলিকন, মিনারেল ওয়েল বা অ্যালকোহল, যেগুলো কোঁকড়া চুলকে আরও শুষ্ক করে, সেগুলো ব্যবহার করা হয় না। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই স্ট্রেইট চুলের তুলনায় কোঁকড়া চুল শুষ্ক হয়। এর পরিবর্তে সিজিএম মেথডে ময়েশ্চারাইজিং, চুলের জন্য পুষ্টিকর ও ক্ষতিকর নয় এমন উপাদান ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও, স্ট্রেইটনার, কার্লিং, আয়রন এবং প্রচলিত তোয়ালে দিয়ে চুল শুকানোর পদ্ধতিও এড়িয়ে চলা হয়।
এবার আসা যাক সিজিএম নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো খোলাসা করার দিকে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, কোঁকড়া চুলের যত্নে যে পণ্যগুলো ব্যবহার হয় তা কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু পদ্ধতিটি স্ট্রেইট চুলের যত্নের মতোই সহজ এবং এতে কোনো অতিরিক্ত ঝামেলা নেই। কাজরিয়ার মতে, এই মেথড অনুযায়ী সপ্তাহে একবার চুল ধোয়া যথেষ্ট। তিনি বলেন, 'যেদিন আমি চুল ধুই, তখন প্রথমে সালফেট মুক্ত শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করি, এরপর সিলিকনমুক্ত কন্ডিশনার দিয়ে ডিপ কন্ডিশন করি। অতিরিক্ত পানি শুষে নেওয়ার জন্য একটি পরিষ্কার, পুরোনো ও ঢিলেঢালা টি-শার্ট দিয়ে চুল প্যাঁচিয়ে নিই। যদি চুলে কোনো স্টাইল করতে না হয়, তবে বাইরে যাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।'
চুল স্টাইল করার জন্য কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়। চুল ভেজা অবস্থায় কার্লিং ক্রিম ও জেল ব্যবহার করা হয়। ক্রিম চুলের টেক্সচার বজায় রাখে, আর জেল নিশ্চিত করে যে বাইরে থাকার সময় বাতাস, রোদ বা দূষণের কারণে চুলের স্বাভাবিক কোঁকড়া আকৃতি নষ্ট না হয়।
চুল ধোয়ার ক্ষেত্রে প্রতিদিন শ্যাম্পু ব্যবহার না করে কো-ওয়াশ করার পরামর্শ দেন কাজরিয়া, বিশেষ করে যাদের স্ক্যাল্প দ্রুত তৈলাক্ত হয়ে যায় তাদের জন্য। তিনি বলেন, 'কো-ওয়াশিং বলতে বোঝায় কন্ডিশনারের সঙ্গে এক পাফ শ্যাম্পু মিশিয়ে সেটিকে ক্লিনজারের মতো করে চুলে ব্যবহার করা।" এতে চুল ভালোভাবে পরিষ্কার হয় এবং ত্বক শুষ্ক না করেই অতিরিক্ত তেলতেলে ভাব দূর হয়।'
স্ট্রেইট চুলের যত্নে যেমন দামি প্রোডাক্টের পাশাপাশি ঘরোয়া উপাদান ব্যবহার করা হয়, তেমনি কোঁকড়া চুলের যত্নেও এই দুটোরই সমান গুরুত্ব রয়েছে।
কাজরিয়া আরও বলেন, শ্যাম্পুর বিকল্প হিসেবে রিঠা পাউডার বা ডাল ধোয়া পানি এবং ডিপ কন্ডিশনিংয়ের জন্য বিভিন্ন হারবাল প্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে চুল ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসে না, যা সিজিএমের একটি বড় ইতিবাচক দিক।
তিনি আরও জানিয়েছেন, সেদ্ধ সাবুদানার সঙ্গে তাজা অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে চুলে লাগালে এটি প্রাকৃতিক ডিপ কন্ডিশনিং মাস্ক হিসেবে চমৎকার কাজ করে।
কোঁকড়া চুল স্টাইলিংয়ের জন্য তিনি তিসির বীজ থেকে তৈরি আরেকটি চমৎকার জেলের কথা বলেছেন। গরম পানিতে তিসির বীজ সিদ্ধ করলে একটি আঠালো পদার্থ বের হয়। এটি ছেঁকে বক্সে সংরক্ষণ করে ডিপ ফ্রিজে রাখুন, কারণ দ্রুত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্যবহারের আগে প্রয়োজনমতো বের করে গলিয়ে চুলে ব্যবহার করুন।
কাজরিয়া বলেন, 'ফ্যাক্টরিতে বানানো যেকোনো জেলের চেয়ে এই জেল অনেক বেশি কার্যকর।'
'এই পরিবর্তন কালটা কিছুটা কঠিন হতে পারে। এ সময়ে আপনি চুল স্ট্রেইট করতে পারবেন না কিংবা কোনো ধরনের হিটিং স্টাইলার ব্যবহার করা যাবে না। চুলে কোনো রাসায়নিক পণ্য প্রয়োগ থেকেও বিরত থাকতে হবে এবং এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। এই সময় কিছুটা চুল পড়াও স্বাভাবিক।'
তিনি মনে করেন, পরিবর্তনের এই সময়টা অনেকের জন্যই হতাশার হতে পারে। তবে মনে রাখা জরুরি যে, এই পর্যায়ে আপনার চুল বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্যের কারণে হওয়া ক্ষতি থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছে এবং আবার স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথে ফিরছে। একবার এই ধাপটি পার হয়ে গেলে, আপনার স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, ঘন ও কোঁকড়া চুল আপনাতেই ঝলমল করে উঠবে—প্রশংসা কুড়োনোর জন্য একেবারে প্রস্তুত।
মডেল: কাজরিয়া কায়েস, বাইজিদ হক জোয়ার্দার, নাজিয়া তারিক, রৌদ্র নুরায়েজ আহসান, ধ্রুব নুমায়ের আহসান
ফ্যাশন ডিরেক্টর: সোনিয়া ইয়াসমিন ইশা
লোকেশন: ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঢাকা
অনুবাদ করেছেন শবনম জাবীন চৌধুরী


Comments