যেখানে খাদ্যাভ্যাসের দর্শন ‘সুকু সুকু সাপুরাহ’

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
মালয়েশিয়ান খাবার। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

খাদ্য নৃতত্ত্বের জনক সিডনি মিন্টজ বলেছিলেন—কোনো অঞ্চলের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা মানে একটি বীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখা, যার ভেতর দিয়ে ওই সমাজের মানুষের ইতিহাস আর মনস্তত্ব টের পাওয়া যায়। তাই মালয়েশিয়া ভ্রমণের সুযোগ যখন এলো, তখন উদরপূর্তির মাধ্যমে ইতিহাস আর মনস্তত্ত্ব পাঠের সুযোগ ছাড়তে চাইনি। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে মালয়েশিয়ার স্থানীয় খাবার সম্পর্কে রীতিমতো পড়াশোনা করে গেছি। সেই বর্ণিল খাদ্য-অভিজ্ঞতাই আজকের গল্প।

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
নাসি কান্দার।

মালয়েশিয়া নেমে ইমিগ্রেশনের ধাক্কা সামলে আমার প্রথম চিন্তা ছিল এখনই খেতে হবে। ক্ষুধা নিবারণে ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান খোঁজা বনাম দ্রুত খাবার খেয়ে ফেলার ভাবনার যুদ্ধে বার্গার, স্যান্ডুইচই জিতে গেল। একটা ক্যাফে খুঁজে হোয়াইট কফি আর টুনা স্যান্ডুইচ অর্ডার দিলাম। বৃদ্ধ দোকানি হাসিমুখে বললেন 'সেলামত দাত্তাং'! গুগল ট্রান্সলেটরে মালয় ভাষা ইন্সটল করতে করতেই খাবার চলে এলো। মুখে দিতেই প্রথম কালচারাল শক! কারণ টুনাটি প্রায় কাঁচা। এই বস্তু অমৃত মনে করে গলধঃকরণের প্রবল প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে মনে পড়লো সংস্কৃত অপ্ত বাক্য 'যঃ পলায়তি সঃ জীবতি'। ট্যাক্সি চলে আসার বাহানায় বৃদ্ধ দোকানীর দিকে হাসি ফিরিয়ে কোনোমতে কফি গলায় ঢেলে দৌড়! এরপরের কাজ হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিয়েই পরবর্তী দিনগুলোতে খাদ্য অভিযানের খসড়া প্রস্তুত করে ফেলা। মালয়েশিয়ার মানুষ ভাত-প্রিয়। আমরা যাকে ভাত বলি, তাই সেখানে 'নাসি'। একেক বেলায় একেকরকম খাবারের প্রচলন এখানে কম।

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
লাকসা।

'নাসি-কান্দার' বলে একটি খাবার এখানে বহুল প্রচলিত। এটি মূলত দক্ষিণ ভারতীয় শ্রমিকদের হাত ধরে পেনাং অঞ্চলে এসেছিল। মালয়েশিয়ান খাবারের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের সংযোজনে নতুন ধরনের খাবার এই 'নাসি-কান্দার'। রাত দিন ২৪ ঘণ্টা হোটেল খোলা। ভাতের সঙ্গে মুরগি ভাজা-তরকারি, মাছ ভাজা, করলা, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স সেদ্ধ, পাঁপড় ইত্যাদি একবারে প্লেটে দিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়াও আছে ভাত, মুরগি ভাজা, ডিম পোচ দিয়ে তৈরি খাবার 'নাসি আয়াম'। সঙ্গে স্বাদ বর্ধক 'সাম্বাল'। মালয় ভাষায় নাসি-শব্দের অর্থ ভাত আর 'আয়াম' অর্থ মুরগি। কুয়ালালামপুরে খাবার দোকানের একটা রাস্তা আছে। পরিবেশটা জাঁকজমকপূর্ণ, বর্ণিল আর নামটাও বেশ সুন্দর! 'জালান-আলোর' যার অর্থ সব ধারার রাস্তা। রাস্তাজুড়ে নানান দেশের নানা রকম মানুষ—কেউ পোকার ভাজি খাচ্ছেন, কেউ সমুদ্র ঘোটকের কাবাব এবং কেউ আবার হাঙ্গরের পাখনার স্যুপ!

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
সি হর্সের কাবাব।

এরপর মালয়েশিয়ার শীতলতম শহর ক্যামেরন হাইল্যান্ডের তানাহ রাতাতে খেলাম 'নাসি আয়াম গোম্বাক'। হলুদ রঙের খিচুড়ি সদৃশ ভাত, ক্লিয়ার হার্ব স্যুপ আর সঙ্গে 'আয়াম' অর্থাৎ মুরগি কিংবা 'উদাং' বা চিংড়ি। মাছ, গরু, মুরগি আর স্থানীয় নানা প্রকার হার্ব দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ তৈরি হয় ক্যামেরনে।

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
রোটি চানাই।

এরপর বলা যেতে পারে 'নাসি কান্দারের' শহর পেনাং গিয়ে নাসি কান্দারের স্বাদ নেওয়ার গল্প। পেনাংয়ের জর্জটাউন এমনিতেই পথ-চিত্রের জন্য ইউনেস্কো ঐতিহ্য বলে স্বীকৃত। সেখানেই বিশাল সব দোকানে মানুষ লাইন ধরে 'নাসি কান্দার' খাচ্ছেন। আগেই বলেছি ঐতিহাসিকভাবেই পেনাং নাসি কান্দারের শহর। এছাড়াও পেনাং বিখ্যাত 'নাসি-লেমাক'-এর জন্যও। নারকেলের দুধে জ্বাল দিয়ে তৈরি ভাতে বাদাম, শুটকি গুঁড়ার টপিং আর ভাজা মুরগি দিয়ে 'নাসি-লেমাক' পরিবেশিত হয়। কাজের খোঁজে এ অঞ্চলে আসা দক্ষিণ ভারতীয় মানুষেরা আরও একটি খাবার মালয়েশিয়ান কুইজিনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এর নাম 'রোটি চানাই'। সকালের খাবার হিসেবে এটি বেশ নামকরা। সেদ্ধ কিংবা ভাজা রুটি আর চানার ডালে ডুবিয়ে খাওয়া, সঙ্গে থাকতে পারে 'তেলুর মাতা' বা ডিম পোচ কিংবা 'তেলুর দাদার' বা ডিম ভাজি।

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
বাকসো।

ভ্রমণের শেষ অংশে এলাম সমুদ্র শহর লংকাউইতে। এখানে খেয়েছি 'লাকসা' ও 'বাকসো'। সঙ্গে নাসি বা ভাত জাতীয় খাবার তো ছিলই। অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলের মানুষও বেশ ডাম্পলিং বা মমো খান, সঙ্গে আমাদের সিঙ্গারা-সমোসার মতো ভেতরে মাংসের পুর দেওয়া পিঠা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি হয় দেদারসে। 'লাকসা' আর 'বাকসো' দুটাই এই অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত। লাকসা একটু ঝাল ঝাল এক ধরনের স্যুপ। এতে ভাতের তৈরি ন্যুডলস, মাছ, শুকনো মাছের গুঁড়া, অর্ধেক করে কাটা ডিম, লেবু, স্যুপ, স্পাইস আর স্থানীয় হার্ব দেওয়া হয়। বেশ ঝাল এই খাবারটি আমাদের পরিচিত হালিমের গোত্রভাই কিংবা মারমাদের ঐতিহ্যবাহী 'মুন্ডি'র আত্মীয় বলে ধরে নেওয়া যায়। 

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
নাসি গোরেং।

আরেকটি খাবার নিয়ে আলোচনা করা যায়—বাকসো। 'বাকসো' সীমানার ওপারে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াতেও বেশ জনপ্রিয়। 'বাকসো' তৈরি হয় ফিস বল এবং বিফ বল দিয়ে, সঙ্গে ক্লিয়ার স্যুপ ও স্থানীয় হার্ব ও নুডলস যুক্ত করে। এই খাবারগুলো ছাড়াও স্থানীয় মানুষদের ডুরিয়ান এবং কাঁঠাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে দেখেছি, সঙ্গে থাকে নারকেলের দুধ। ডুরিয়ান ফল দিয়ে খাওয়া আরেকটি খাবার 'চেন্দল'। এটি মালয়েশিয়ায় জনপ্রিয়তম ডেজার্ট। ভাত (ইদানীং কালে কুসকুস ব্যবহৃত হচ্ছে), নুডুলস, নারকেলের দুধ আর সঙ্গে টপিং হিসেবে এক খণ্ড ডুরিয়ান।

মালয়েশিয়ার খাবার, নাসি কান্দার, নাসি লেমাক, রোটি চানাই, লাকসা, বাকসো, মালয়েশিয়ান ফুড কালচার, সুকু সুকু সাপুরাহ, মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার, মালয়েশিয়ার স্ট্রিট ফুড, মালয়েশিয়ান ডেজার্ট, চেন্দল, মালয়েশিয়ার খাদ্য দর্শন, মালয়েশিয়ার ভ্রমণ খাদ্য অভিজ্ঞতা,
নাসি আয়াম গোম্বাক, ক্যামেরন হাইল্যান্ড।

মালয়েশিয়ার 'আসলি' বা আদিবাসিন্দার প্রধান খাবার ভাত বা নুডুলস আর এর সঙ্গে ভাজা, তরকারি, সবজি ইত্যাদি। এখানে খাবারের পরিমাণের চেয়ে সুষম খাদ্য উপাদান বণ্টনের ওপর জোর দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। 'সুকু সুকু সাপুরাহ'—যেটি এই লেখার শিরোনাম—এর অর্থ প্রতিবেলার খাবার প্লেটকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হবে। এক-চতুর্থাংশ, এক-চতুর্থাংশ এবং অর্ধেক। প্রথম চতুর্থাংশে থাকবে প্রোটিন, দ্বিতীয় চতুর্থাংশে কার্ব এবং বাকি অর্ধেকজুড়ে সবুজ সবজি। সুস্থতার জন্য দারুণ এই ধারণা এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বেলাতেই খাবারের প্লেটে যেন পুষ্টিগুণ নিশ্চিত হয়, এটাই মালয়েশিয়ার দর্শন। এ প্রসঙ্গে হিপোক্রিটাসের 'ডি আলিমেন্তো'-কে স্মরণ করাই যায়। যার অর্থ, প্লেটের খাবার হোক তোমার ওষুধ আর রোগের ওষুধ হোক তোমার প্লেটের খাবার।

Comments