ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করার যত ঘরোয়া উপায়

ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করার ঘরোয়া উপায়
ছবি: সংগৃহীত

নিত্যদিনের খাবার সংরক্ষণে একটি অপরিহার্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র ফ্রিজ। বিশেষ করে ব্যস্ত মানুষদের জন্য প্রতিদিনের খাবার কেনা বা রান্না করার সেরা বিকল্প এই গৃহস্থালি পণ্য।

কিন্তু সঠিক যত্নের অভাবে দুর্গন্ধের ফলে এই উপকারী বস্তুটিই উল্টো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরে খাবার ভালো রাখতে অসুবিধার পাশাপাশি ঘরের ভেতর সৃষ্টি হয় নোংরা পরিবেশের। চলুন ফ্রিজের দুর্গন্ধের কারণ এবং তা দূর করার ঘরোয়া উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

যে কারণে ফ্রিজে দুর্গন্ধ হয়

প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সময় ধরে খাবার রাখা

দীর্ঘদিন ধরে খাবার সতেজ রাখার জন্যই ফ্রিজ। কিন্তু এরপরেও প্রতিটি খাবারের এই সতেজতার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ বা নষ্ট এই খাবারগুলোর পচনের ফলে সৃষ্ট দুর্গন্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর এ ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে ফ্রিজের ভেতরের পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।

ডিপ ট্রে বা প্যানে জমে থাকা পানি

ফ্রিজ ডিফ্রস্ট বা বরফ গলে যাওয়ার পর পানি জমা হয় ডিপ প্যানে। দীর্ঘ সময় এই জমে থাকা পানির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সময়মতো পানি অপসারণ করা না হলে প্যানের এই অংশে ক্ষতিকারক দূষিত পদার্থ জমে বাজে গন্ধ সৃষ্টি করে।

ফ্রিজের ভেতরটা নোংরা রাখা

খাবার রাখার সময় ফ্রিজের ভেতরে খাবারের কোনো অংশ ছিটকে পড়ছে কি না তা অনেকেই খেয়াল করেন না। উচ্ছিষ্ট অংশগুলো এভাবেই রেখে দিলে দিন শেষে ফ্রিজের ভেতরের অবস্থা একদম নোংরা হয়ে যায়। সেইসঙ্গে বিভিন্ন খাবারের গন্ধ মিলে এ সময় উটকো গন্ধ ছড়ায়।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফিল্টার

পানির ফিল্টার ফ্রিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম, যা ফ্রিজের আভ্যন্তরীণ নানাবিধ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও এই ফিল্টার পরিবর্তন না করা হলে এতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং রাসায়নিককে বস্তু জন্মায়। এর মধ্যে যে কোনো সময় ফিল্টার অকেজো হয়ে গেলে তা থেকে বাজে গন্ধ বের হয়।

এ ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন সরঞ্জামের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দীর্ঘমেয়াদে ফিল্টারে জন্মানো সেই দূষকগুলো খাবার পানীয় এবং বরফের সঙ্গেও মিশে যায়। এভাবে ফিল্টারের কারণে সম্পূর্ণ ফ্রিজটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অস্বাস্থ্যকর হয়ে যেতে পারে।

খাবারের পাত্রে উপযুক্ত ঢাকনা ব্যবহার না করা

ফ্রিজে খাবার রাখার সময় পাত্রে ঢাকনা দিয়ে রাখাটা সংরক্ষণের উপযুক্ত উপায়। কিন্তু ঢাকনাটি সঠিক ভাবে খাবারকে ঢেকে রাখছে কি না তা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে অল্প একটু অনাবৃত থাকলেও সংশ্লিষ্ট খাবারের গন্ধটি সমগ্র ফ্রিজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, রসুন বা পনিরের মত অবিরাম গন্ধ ছড়ানো খাবারগুলো এ অবস্থায় দুর্গন্ধের কারণ হতে পারে।

ফ্রিজের দরজা খোলা রাখা

জানা থাকা সত্ত্বেও যে ভুলটি ফ্রিজ ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি করে থাকেন, তা হচ্ছে ফ্রিজের দরজা পুরোপুরি বন্ধ করতে ভুলে যাওয়া। ফ্রিজের দরজা অল্প খোলা থাকলেও স্বভাবতই খাবার দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও অনেক খাদ্যসামগ্রীতে ধীরে ধীরে জীবাণু জমতে শুরু করে। এই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় বাজে গন্ধ ছড়ানো।

ঘরোয়া উপায়ে যেভাবে ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করবেন

তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়া

কখনও কখনও শুধু তাপমাত্রা কমিয়ে ফ্রিজের দুর্গন্ধ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। তাপমাত্রা কমানোটা সবচেয়ে সহজ সমাধান। তবে এ ক্ষেত্রে ঘরের আবহাওয়া কতটুকু আর্দ্র সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেশি আর্দ্রতা রোধ করার জন্য ফ্রিজের তাপমাত্রা অনেকটা কমানোর প্রয়োজন হতে পারে।

ভেতরের বাতাস বের করে দেওয়া

একটি আর্দ্র ও খাদ্য-ভর্তি ফ্রিজ ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য জীবাণু বৃদ্ধির আদর্শ জায়গা। বদ্ধ অবস্থায় ফ্রিজের অভ্যন্তর ভাগের গন্ধ ফ্রিজের দেয়াল ও তাকগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রিজ বন্ধ করে দরজা খুলে ভেতরের বাতাস বের করে দিলে তার সঙ্গে এই গন্ধও বেরিয়ে যায়। এর জন্য ভেতরের প্রত্যেকটি অপসারণযোগ্য অংশ খাবারসহ বাইরে বের করে আনতে হবে।

তারপর ভালোভাবে পরিষ্কার করে সেগুলোকে আবার জায়গামতো সেট করে দিতে হবে। ফ্রিজের অভ্যন্তরটি মুছে ফেলার পর পুনরায় খাবার জমা করার আগে প্রায় এক ঘণ্টার জন্য দরজা খোলা রাখতে হবে।

নষ্ট খাবার বর্জন করা

ফ্রিজের ভেতর খাবার কতদিন ধরে রাখা হচ্ছে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকা জরুরি। কারণ ফ্রিজের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে নষ্ট বা মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বর্জনের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রতিদিন নিয়ম করে ফ্রিজের খাবারগুলোর অবস্থা তদারক করা আবশ্যক।

দুর্গন্ধ শোষক ব্যবহার করা

ফ্রিজের বাজে গন্ধ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট উপায় হলো গন্ধ শোষক ব্যবহার করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটি ব্যবহৃত হয়, তা হলো বেকিং সোডা, যা চারকোল বা কাঠকয়লা থেকেও ভালো কাজ দেয়। বর্তমানে কিছু সিএলও২ (ক্লোরিন-ডাই-অক্সাইড) ভিত্তিক পণ্যেও চারকোলের চেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যায়।

লেবু বা কমলা অর্ধেক করে কেটে তাক বা পাত্রে রাখা যেতে পারে। এই সাইট্রাস ফলগুলো প্রাকৃতিকভাবেই ফ্রিজের খারাপ গন্ধকে সুগন্ধিতে প্রতিস্থাপন করতে পারে।

অল্প পরিমাণে সাদা ভিনেগার একটি ছোট বাটিতে ভরে ফ্রিজে রাখা যেতে পারে। ভিনেগারের তীব্রতা দুর্গন্ধের পাশাপাশি ফ্রিজের ভেতরকার স্যাঁতস্যাঁতে ভাবও দূর করে।

ফ্রিজের খারাপ গন্ধ দূর করার আরও একটি মোক্ষম উপায় হচ্ছে কফির বীজ। তবে কফির গন্ধ অন্যান্য খাবারগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাই এর কাছাকাছি প্যাকেজবিহীন খাবারগুলো না রাখাই ভালো।

ভেতরের ট্রে বা প্যান পরিষ্কার করা

ডিপ প্যান বা ট্রের অবস্থান ফ্রিজের নিচে ও পেছন দিকে হওয়ায় প্রায় সময় তা নজর এড়িয়ে যায়। এটি ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করার জন্য পুরো ট্রে বা প্যানটি বের করে আনতে হবে। তারপর এটিকে সিঙ্কে নিয়ে জমে থাকা সমস্ত পানি ধুয়ে ফেলতে হবে এবং লেগে থাকা ময়লাগুলো ভালোভাবে ঘষে তুলতে হবে।

এক্ষেত্রে হালকা গরম পানির স্প্রে ব্যবহার করা ভালো। সবশেষে, ফ্রিজে পুনঃস্থাপন করার আগে ধুয়ে ফেলা ট্রে সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে নেওয়া শ্রেয়। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ফ্রিজের ডিপ ট্রে পরিষ্কার করা উচিত।

ফিল্টার নিয়মিত বদলে দেওয়া

ফ্রিজের পানির ফিল্টারের মেয়াদ সাধারণত সর্বোচ্চ ৬ মাসের হয়ে থাকে। মেয়াদ পার হওয়ার পর পরই পুরনো ফিল্টার বদলে একটি হাই কোয়ালিটির পানির ফিল্টার লাগানো জরুরি। এই অপরিহার্য বস্তুটির ব্যাপারে উদাসীন থাকা মানেই ফ্রিজ ব্যবহারে কিছু দিন পরপর হয়রানির শিকার হওয়া।

ফ্রিজের পুরো ভেতরের অংশ পরিষ্কার করা

খারাপ গন্ধ দূরীকরণে পরিপূর্ণভাবে সন্দেহ মুক্ত থাকার সেরা উপায় হলো ফ্রিজের গোটা ইন্টেরিয়র পরিষ্কার করে ফেলা। এর জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে ফ্রিজের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সমস্ত খাবার বের করে আনা। তারপর অপসারণযোগ্য ড্রয়ার ও তাকগুলো বিচ্ছিন্ন করে কুসুম গরম পানি এবং সাবান দিয়ে ভিতরের অংশটি ধুয়ে ফেলা।

তারপর একটি পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠগুলো মুছে নেওয়া। সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে গেলে তারপর ড্রয়ার ও তাকগুলো আবার যথাস্থানে বসিয়ে খাবারগুলো ঢুকিয়ে ফেলা।

ফ্রিজের গ্যাসকেট পরিষ্কার করা

রেফ্রিজারেটরের দরজার ভেতরকার রাবারের তৈরি সিলটির নাম গ্যাসকেট, যেটি ফ্রিজের ভেতরে বাতাসের চলাচলকে বাধা দেয়। এটি পরিষ্কার করার জন্য হালকা গরম পানিতে ভেজা স্পঞ্জ বা নরম কাপড় এবং হাল্কা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ভালোভাবে ধুয়ে ফেলার পর একটি পরিষ্কার ও নরম কাপড় দিয়ে গ্যাসকেটটি মুছে নিতে হবে।

ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য দুর্গন্ধ সৃষ্টির কারণগুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। মূলত খাবারের সঠিক সংরক্ষণের পাশাপাশি ফ্রিজের ভেতরের যাবতীয় সরঞ্জাম পরিষ্কারে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। তাই প্রয়োজন নিয়মিত এই যন্ত্রটি পরিষ্কার রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা। এতে করে ফ্রিজে কোনো খাবার কতদিন ধরে রাখা আছে বা ফ্রিজের ভেতরটা কতদিন পরিষ্কার করা হয়নি তা জানা থাকবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

22 sectors still pay wages below poverty line

At least 22 sectors in Bangladesh continue to pay their workers much less than what is needed to meet basic human needs.

10h ago