‘না’ বলতে শেখা কেন জরুরি

প্রতীকী ছবি

আমাদের সমাজে `ভালো নারী' বলতে বোঝানো হয় সেই নারীদের যারা অন্যের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করেন, নিজের স্বার্থের কথা ভাবেন না এবং সহজেই যেকোনো কিছু মেনে নেন। আমি যদি বলি, এই বৈশিষ্ট্যগুলোই আপনাকে পেছনের দিকে টেনে ধরার জন্য যথেষ্ট, তাহলে?

আমাদের পরিবারে মেয়েদের শেখানো হয়, `ভালো ব্যবহার করো, ভালো মেয়ে হও এবং অন্যের প্রতি দয়াশীল হও'। তাই যখন আমাদের সমাবর্তনে শিল্পী জুডি শিকাগো বললেন, `মনে রাখবে, এক জীবনে তোমার পক্ষে সব কিছু হওয়া সম্ভব নয়, তোমাকে নিজের জন্য পথ বেছে নিতে হবে', তখন আমি তার কথায় দ্বিমত পোষণ করলাম। কারণ আমাকে শেখানো হয়েছে, আমি যদি সবার কথায় একমত পোষণ করি তাহলে আমি ভালো থাকব এবং যা চাই সব পাব। 

কিন্তু, আমার ছেলের জন্মের কিছুদিন পর এই চিন্তার ঘর অনেকটা যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। আমার কাজ, সামাজিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন নতুন এক ধাক্কা খেলো। আমি যেসব কাজ করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম, তার কিছুই করতে পারছিলাম না। আমি মরিয়া হয়ে সেই পুরোনো আমাকে খুঁজে পেতে চাইছিলাম যাকে সবাই ভালোবাসতো। যে কখনো সেই ছোট অথচ ভয়ঙ্কর শব্দ `না' উচ্চারণ করেনি। আমার মনে হচ্ছিল, আমি কাউকে কিছুই দিতে পারছি না, মনে হচ্ছিল আমি ব্যর্থ মানুষে পরিণত হচ্ছি।

সে সময় স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, আমার মধ্যে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। নিজের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন, সেটাও বুঝছিলাম। কিন্তু এই বিষয়টা ছিল আমার জন্য একেবারে নতুন। মনে হচ্ছিল আমি বুঝি কোনো গোপন কাজ করতে যাচ্ছি। তাই নতুন কিছু শুরু করার আগে আমি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছিলাম, `না বলতে শুরু করলে আসলেই কি আমার জীবন ভালোর দিকে যাবে?' যদি এর উত্তর নেতিবাচক পাই তাহলে বুঝতে হবে, `না' বলার সময় এসেছে।

কাজটা আমার জন্য সহজ ছিল না। সত্যি বলতে কী, আমার শারীরিক যন্ত্রণা হচ্ছিল—পেটের মধ্যে কেমন করছিল, হাতের তালু ঘামছিল। সেসময় আমি দুই ধাপের কৌশল অবলম্বন করেছিলাম। প্রথমটি হলো সেই পুরোনো পদ্ধতি, অনেকটা নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য ক্যালেন্ডার চেক করা। তারপর ইমেইল আর হোয়াটসঅ্যাপ চেক করা। আর বলা, `আমি খুব দুঃখিত, কিন্তু আসলেই আমার একদম সময় নেই।'

তবে ধীরে ধীরে নিজের এই অস্বস্তির বরফ গলতে শুরু করল। একসময় বিড়বিড় করে `না' উচ্চারণ আর সেজন্য ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে আমি স্পষ্ট করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে `না' বলতে শিখে গেলাম। যেমনটা দ্য বেল জারের পর্যবেক্ষণে সিলভিয়া প্লাথ বলেছেন, `না বলার কথা আমার কখনো মাথায়ই আসেনি।' তার এই কথাগুলো এত গভীর যে, `না' বলার জন্য দ্বিধাগ্রস্ত একজন ব্যক্তিকেও মুক্তির পথ দেখায়।

আমার জন্য `না' বলতে পারার সাহস জোগানোটা সবসময়ই জুডি শিকাগোর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তার বক্তব্য শোনার বহু বছর পর ব্রুকলিন জাদুঘরে তার অসাধারণ সৃষ্টি `দ্য ডিনার পার্টি' দেখেছি। এই যুগান্তকারী স্থাপনাটি আসলে শিল্প, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি থেকে নারীকে ঐতিহাসিকভাবে মুছে ফেলার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী `না'। এটি নারীর অর্জনকে যেখানে উপেক্ষা করা হয় বা তুচ্ছ করা হয়, তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সামাজিক নানা সীমাবদ্ধতার পরেও নারীদের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো তুলে ধরে `ডিনার পার্টি'। নারীর ঐতিহাসিক ভূমিকা বজায় রাখার যে দাবি, তার বিরুদ্ধে অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আওয়াজ তুলছেন, `না' বলতে শুরু করেছেন। কৌশলগতভাবে যা আসলে নারীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার জায়গা তৈরি করছে।

আমার ছেলের কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক যখন ফোন করলেন এবং তার লেখা ও পড়ার সমস্যা নিয়ে চিন্তার কথা জানালেন, সেই মুহূর্তে আমার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল অগ্রাধিকার ঠিক করা। আমার অকারণে ব্যস্ত থাকা জীবনে হঠাৎ করেই যেন সব কোলাহল থেমে গেল। আমি ডিনারের দাওয়াত আর নিত্য আড্ডার আমন্ত্রণকে `না' বলতে শুরু করলাম। নিজের কর্মক্ষেত্রের বাইরে আমার দুনিয়াটা ছোট করে ফেললাম। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ছেলের লেখাপড়ায় গতি আনা, তাকে সাহায্য করা। আমি তার শিক্ষকদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে শুরু করলাম, প্রতি সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে পড়তে বসতে শুরু করলাম। এটা খুবই কাজে দিল। সেখান থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে, জীবনে গুরুত্ব নির্ধারণ জরুরি এবং এজন্য অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একেবারেই বাদ দেওয়া যেতে পারে।

আমার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় `না' বলা এসেছিল বাংলাদেশে ফিরে আসার পর। সে সময় আমি অবিশ্বাস্যভাবে দারুণ একটি চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলাম। আর সেটি ছিল বিদেশি বিনিয়োগে একটি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তাব। সেখানে আমি অনেক কিছু শিখেছি, একটি প্রতিষ্ঠানকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যাই হোক, প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর কাজটি আমার জন্য খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। সেখানে আমার পেশাগত উন্নয়নের আর কোনো বিষয় ছিল না। ফলে সেসময় ইচ্ছা না করলেও আমি দায়িত্ব পালন করে গিয়েছি। এক পর্যায়ে `না' করে দিতে সমর্থ হই এবং আমার বদলে নতুন লোক খুঁজে নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে চার মাস সময়ও দিই। 

নিজেকে দেওয়া সেরা উপহার: 'মি' টাইম আর চারপাশে সীমারেখা টানা

`না' বলতে শেখার পর আমি নিজের জন্য অনেকটুকু সময় বের করতে পেরেছি, যা নিজের যত্ন নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ হাজার কদম হাঁটতে শুরু করলাম। শুধুই হাঁটা। নিজেকে দেওয়া এই অগ্রাধিকার কোনো স্বার্থপরতা নয়। এটি ছিল আমার নিজের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমি নিজের চারপাশে একটা সীমানাও টেনে দিতে পেরেছিলাম। এমনকি প্রিয় বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের জন্যও। যারা মানুষ হিসেবে অসাধারণ হলেও প্রায়ই আমার কাছ থেকে সাধ্যের চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করতেন। নিজের জন্য সময় বের করার পর যেটা হলো, আমার অন্য কোনো কাজ থাকলে তাদের সেটা স্পষ্ট করে বলতাম। যদি তাদের কোনো আচরণ আমার খারাপ লাগত, তাহলে তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতাম। 

এটা আমাকে মুক্তির অনুভূতি দিয়েছিল, যা অনেকটা ছিল মহাশক্তির মতো। আমি মহাভারতের গঙ্গার মতো অনুভব করছিলাম, নিজের ইচ্ছামতো কিছু না পাওয়ায় যিনি চলে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন। একইভাবে, আমি নিজের মতো পথ চলতে শুরু করলাম এবং নিজের শর্তে বাঁচতে শুরু করলাম। এসব দেখে কেউ কেউ আড়ালে আবডালে আমাকে 'স্বার্থপর' বলতে শুরু করলেন, কিন্তু আমি নিজের ওপর খুবই খুশি ছিলাম। আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। আমার জীবনে তখন শান্তির অর্থ ছিল তীক্ষ্ণ মনোযোগ এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। যেভাবে গ্লোরিয়া স্টেইনমেন বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাদের মনে করিয়ে দেন, `একবার যখন আমরা অন্যের অনুমোদন পাওয়ার প্রত্যাশা ছেড়ে দিই, তখন সম্মান অর্জনটা অনেক সহজ হয়ে যায়'। এটাই হলো `না' বলতে পারার মূল কথা, যেখানে নিজের আত্মসম্মানের জন্য অন্যের অনুমোদন পাওয়ার ভরসায় আর থাকতে হয় না।

`না' বলতে পারার মহাশক্তি পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি

এখন আমার এই লক্ষ্য ছেলের কাছেও পৌঁছে দিচ্ছি। সে খুবই দয়ালু প্রকৃতির, সবসময় তার বন্ধুদের সহায়তা করার জন্য এক কদম এগিয়ে থাকে। তার এ বৈশিষ্ট্য দেখে আমি খুবই গর্বিত। কিন্তু আমি এটাও জানি, নিজের চারপাশে সীমারেখা আঁকতে শেখানোও কত জরুরি। কারও প্রতি সত্যিকার অর্থে সহমর্মী হওয়ার অর্থ চিরস্থায়ী আত্মত্যাগের পথে হাঁটা নয়। বরং এটি নিজের ভালো থাকার জন্যও জরুরি। যেন আপনি সত্যিকার অর্থে সুখী হতে পারেন, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারেন এবং অন্যকে কার্যকরভাবে সাহায্য করতে পারেন। আমার রূপান্তরটা শুরু হয়েছিল ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী শব্দ `না' বলতে পারার মাধ্যমে। এটি এমন একটি শব্দ যা আমাদের সংকুচিত করে না বরং আমাদেরকে নিজের সঠিক সংজ্ঞা দিতে শেখায়। নিজের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান সংকুলান করে দেয়। ইতিহাসের দিকে তাকালেও এই কথার সত্যতা মেলে। বিশ্বজুড়ে সেই নারীরাই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন যারা প্রথাগত প্রত্যাশাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। 

এরকমই একটি চরিত্র হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম ও একমাত্র নারী যাকে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি পুরুষতন্ত্রের রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং স্বামীর ভূমিতে সতীনের সঙ্গে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডের রাণীর দেওয়া 'বেগম' উপাধিও তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তার এই গল্প আমাদের মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সেই জাদুকরী শব্দ অর্থাৎ `না' বলতে পারাকে অনুপ্রাণিত করে। 

অনুবাদ করেছেন জ্যোতি রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Tug-of-war over water lily continues

The Election Commission and National Citizen Party remain locked in a heated debate over the party’s choice of electoral symbol, the water lily -- a dispute that began in June.

3h ago