পেঁয়াজের ইতিবৃত্ত

পেঁয়াজের ইতিবৃত্ত
ছবি: সংগৃহীত

পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা আমরা ভাবতেই পারি না। বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, সবারই মাথা গরম হয়ে ওঠে! মশলা বা সবজি, পেঁয়াজকে যাই ভাবুন না কেন—রন্ধনশিল্পে এর গুরুত্ব আদিকাল থেকেই স্বীকৃত। এটি কাটলে চোখে পানি আসে, কিন্তু খাবারে এনে দেয় অনন্য স্বাদ।

পেঁয়াজ বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত সবজিগুলোর একটি। জাতিসংঘের হিসাবে, অন্তত ১৭৫টি দেশ পেঁয়াজ চাষ করে। রান্নার স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি পেঁয়াজের বহু ঔষধি গুণ বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। এই পেঁয়াজের ইতিহাস কয়েক হাজার বছর পুরোনো। আসুন, জেনে নেই পেঁয়াজের ইতিবৃত্ত।

কোথা থেকে এলো পেঁয়াজ?

পেঁয়াজের উৎপত্তি ঠিক কোথায় ও কখন—তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। তবে গবেষকদের বড় একটি অংশ মনে করেন, এর উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়। অনেকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয়।

ধারণা করা হয়, কৃষিকাজ শুরু করার আগেই আমাদের পূর্বসূরী বন্য মানুষেরা পেঁয়াজ খেত। গবেষকেরা বলেন, মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগে কিছু মানব বসতিতে সবজি হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, সবজিটি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের খাদ্যতালিকায় ছিল।

প্রাচীন আমলে চাষ করা সবজির একটি ছিল পেঁয়াজ। গবেষকদের মতে, পেঁয়াজ পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চাষ করা হচ্ছে। হবে না-ই বা কেন?

পেঁয়াজ সহজে জন্মায়। বিভিন্ন মাটি ও জলবায়ুতে মানিয়ে নেয়। দীর্ঘদিন রাখলেও নষ্ট হয় না। সহজে বহন করা যায়। এসব কারণেই প্রাচীন যুগের মানুষদের কাছে পেঁয়াজ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য।

প্রাচীনকালে খরার মৌসুমগুলোতে খাবারের অভাব দেখা দিত। ওই সময়গুলোর কথা ভেবে পুরোনো দিনের মানুষেরা পেঁয়াজ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতো। তৃষ্ণা নিবারণেও সাহায্য করত পেঁয়াজ।

প্রাচীন সভ্যতায় পেঁয়াজ

প্রাচীনকালের বিভিন্ন দলিলে খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের গুরুত্ব এবং শিল্প, চিকিৎসা ও মমিতে এর ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।

চীনে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বাগান করে পেঁয়াজ চাষ করা হতো। ভারতের প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যেও পেঁয়াজের কথা বলা হয়েছে।

মিশরে পেঁয়াজ চাষ হতো খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে থেকেই। সুমেরীয়রা খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে পেঁয়াজ চাষ করত—এমন প্রমাণও মিলেছে।

প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পেঁয়াজ শুধু খাবার নয়—পবিত্র বস্তুও। তারা মনে করত, পেঁয়াজ চিরন্তন জীবনের প্রতীক। পেঁয়াজের গোলাকার গঠন ও একের ভেতর বৃত্তের পর বৃত্ত—এতে তারা অনন্ত জীবনের ধারণা খুঁজে পেত।

ফারাওদের (ফেরাউন) সমাধিতে পেঁয়াজ রাখা হতো। মমির বুক পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। রাজা চতুর্থ রামেসিসের (১১৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান) মমির দুই চোখের কোঠরেও পেঁয়াজ পাওয়া গেছে।

সৎকারের সময় মৃত ব্যক্তিকে পেঁয়াজ উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিল কিছু জায়গায়। অনেক মিশরীয় বিশ্বাস করত, পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ এতটাই জাদুকরী যে মৃতকে আবার শ্বাস নিতে সাহায্য করবে। পরলৌকিক জীবনেও পেঁয়াজ কাজে আসবে বলে মনে করা হতো। বহু মিশরীয় পিরামিডের দেয়ালের চিত্রকর্মে পেঁয়াজ আঁকা পাওয়া গেছে। পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নার মেন্যুতেও ছিল পেঁয়াজ।

গবেষকদের মতে, প্রাচীন গ্রিসে ক্রীড়াবিদরা শক্তি বাড়াতে পেঁয়াজ খেতেন। খেলার আগে পেঁয়াজ খাওয়া, এর রস পান করা—সবই চলত। রোমান গ্লাডিয়েটররা শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতেন পেশি শক্ত করার জন্য।

গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস জানান, কৃষ্ণসাগরের উত্তরের জাতিগোষ্ঠীগুলো পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও শস্য চাষ করত। হোমারের ইলিয়াডে যোদ্ধাদের খাদ্যতালিকায় পেঁয়াজের উল্লেখ আছে।

প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস। ৪২১ খ্রিস্টপূর্বে তার অভিনীত নাটক 'পিস' (শান্তি)-এ যুদ্ধের দুর্গন্ধকে সৈন্যের ব্যাগের 'বাসি পেঁয়াজের দুর্গন্ধ'র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এটি যুদ্ধের তিক্ততা ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক বোঝাতে বলেছিলেন তিনি।

রোমানরা নিয়মিত পেঁয়াজ খেত এবং ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে ভ্রমণের সময় সবজিটি সঙ্গে রাখত। তারা দাঁতের ব্যথা, অনিদ্রা, মুখের ক্ষত, কুকুরের কামড়, ডায়রিয়া—সব কিছুর উপশমে পেঁয়াজ ব্যবহার করত। রোমান পর্যবেক্ষক প্লিনি দ্য এল্ডার পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষে পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ পেয়েছেন।

অষ্টম ও নবম শতকে প্রাচীন রোমে এপিসিয়াস নামে একজন রন্ধনবিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাকে বিশ্বের প্রথম রান্না নিয়ে লেখা বইগুলোর একজন হিসেবে ধরা হয়। তিনিও তার বইগুলোতে পেঁয়াজের কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন।
আমেরিকায় প্রথম ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা পেঁয়াজ নিয়ে যান। ১৬৪৮ সালে জমি খুঁড়ে পেঁয়াজ লাগানোর কথা পাওয়া যায় তাদের ডায়েরিতে। তবে তার আগেই স্থানীয় আদিবাসীরা বন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করত। খাবার, ওষুধ, রঙ—সব কাজেই পেঁয়াজের ব্যবহার হতো বলে জানা যায়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইতালিতে পেঁয়াজ দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার একটি প্রাচীন লোকাচার এখনো প্রচলিত। ইতালির মার্কে অঞ্চলের উরবানিয়া শহরে ২৪ জানুয়ারি (সেন্ট পলের দিবসের আগের রাত) একটি পেঁয়াজকে ১২টি খণ্ডে ভাগ করে প্রত্যেক খণ্ডে লবণ ছিটিয়ে রাতভর জানালায় রাখা হয়।

পরদিন সকালে লবণ গলে গেলে সেই মাসে বৃষ্টি বেশি হবে, আর শুকনো বা জমাট থাকলে আবহাওয়া শুষ্ক বা ঠান্ডা হবে বলে অনুমান করা হয়। যদিও এই লোকাচার বিজ্ঞানসম্মত না। তবে এই রীতি মধ্যযুগ থেকে চলে আসছে এবং কৃষকদের মধ্যে এখনো জনপ্রিয়।

ধর্মগ্রন্থ, চিকিৎসা ও অর্থনীতিতে পেঁয়াজ

বাইবেলে পেঁয়াজের উল্লেখ আছে। সেখানে মরুভূমিতে খাদ্য সংকট নিয়ে ইস্রায়েলীয়দের হতাশার কথা বলা হয়েছে: 'আমরা স্মরণ করি সেই মাছ যা আমরা মিশরে খেতাম, আর শসা, তরমুজ, পেঁয়াজ ও রসুন।'

ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বিখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিৎসা গ্রন্থ 'চরক সংহিতা'য় পেঁয়াজকে ওষুধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হজম, হৃদযন্ত্র, চোখ—সব কিছুর জন্য পেঁয়াজকে উপকারী বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক চিকিৎসক ডায়োস্কোরাইডিসও পেঁয়াজের ঔষধি গুণ লিখে গেছেন।

পেডানিয়াস ডায়োসকোরিদিসের 'ম্যাটেরিয়া মেডিকা'তে পেঁয়াজের নানা ঔষধি ব্যবহার পাওয়া যায়—হজমশক্তি বাড়ানো, চোখ ও ত্বকের সমস্যায়, ঋতুস্রাবের জটিলতায়, এমনকি কানে ও চুলের সমস্যাতেও।

মধ্যযুগে ইউরোপে পেঁয়াজকে মনে করা হতো সাধারণ মানুষের জীবনরেখা। শিম, বাঁধাকপি আর পেঁয়াজ—এই তিনেই চলত রান্নাঘর। মাথাব্যথা দূর করতে, সাপের কামড়ে নিরাময় হিসেবে ও চুল পড়া কমাতে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হতো।

পেঁয়াজ দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করা হতো। বিয়েতে উপহার হিসেবেও এটি দেওয়া হতো। একসময় পেঁয়াজ অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

পেঁয়াজের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

পেঁয়াজ আসলে একটি কন্দমূল। এতে আছে ভিটামিন বি১ (থায়ামিন), বি২ (রিবোফ্লাবিন), বি৩ (নিয়াসিন), বি৫ (প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড), বি৬, বি৯ (ফোলেট) ও ভিটামিন সি।

পেঁয়াজ একটি শক্তিবর্ধক খাদ্য। এটি সর্দি-জ্বর ও অ্যাজমা উপশমে সহায়ক, হৃদযন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে।

এছাড়া মল-মূত্রসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় উপকারী এবং মাথাধরা ও বমিভাব কমাতেও কার্যকর। এসবের পাশাপাশি পেঁয়াজের আরও নানা স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে।

Comments