প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা থেকে বিরতি নেবেন যেভাবে

প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা থেকে বিরতি নেবেন যেভাবে
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ/স্টার

আমাদের এই অস্থির আর দ্রুতগতির জীবনে প্রযুক্তি থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ প্রযুক্তি ছাড়া সময় কাটানোর প্রয়োজন উপলব্ধি করছেন। কেউ কয়েক ঘণ্টা, আবার কেউ কয়েকদিন প্রযুক্তি ছাড়া কাটানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন নিজের দিকে।

মিলেনিয়ালরা সম্ভবত শেষ প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তিহীন জীবনও দেখেছে, আবার প্রযুক্তিনির্ভর জীবনও দেখছে। জেন-জি প্রজন্মের ক্ষেত্রে বিষয়টি স্পষ্ট। তারা কখনোই প্রযুক্তি ছাড়া থাকেনি। বলা বাহুল্য, কর্মজগতে প্রভাবশালী এই দুই প্রজন্মই স্বীকার করে যে কাজ, দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক যোগাযোগসহ সবকিছুতেই তারা প্রযুক্তির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা প্রযুক্তি ছাড়া থাকলেই তারা বুঝে ফেলে, এই নির্ভরতা আসলে এক ধরনের আসক্তি।

সব সুবিধার পরেও প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে ক্লান্তিকর। কাজের অবিরাম নোটিফিকেশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে 'প্রাসঙ্গিক' প্রমাণ করার চাপ, সব সময় 'অন' হয়ে থাকার তাগিদ এসব কিছু মানসিকভাবে অনেক ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে। আমরা অনেক সময় এই চাপকে আধুনিক জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিই। কিন্তু এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকি না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই অতিমাত্রায় ডিজিটাল জীবনের অসহনীয়তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বুলিংয়ের শিকার হওয়া, কর্মক্ষেত্রে বার্নআউট, বিষণ্ণতা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

তাহলে উপায়? দীর্ঘদিনের চেনা এই জীবনধারা থেকে নিজেকে কীভাবে বের করবেন?

আপনি যদি উপলব্ধি করে থাকেন যে এত বিপুল মাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহার আপনার জন্য ক্ষতিকর এবং এ বিষয়ে কিছু করতে চান, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে আপনি ইতোমধ্যেই ডিজিটাল ডিটক্সের পথে হাঁটছেন। ৩০ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্সার ফারিহা তমা বলেন, 'ছুটিতে গিয়ে ফোন হারানোর পর প্রথম বুঝতে পারি, আমার ক্লান্তির পেছনে মূলত প্রযুক্তিই দায়ী। ফোন ছাড়া সেই কদিন আমি খুব শান্তিতে কাটিয়েছি। ফোনটা ফিরে পাওয়ার পর বুঝলাম, আমি সেটি আগের মতো ব্যবহার করতে চাই না। ছবি তোলার জন্য বারবার ফোন বের না করেও দৃশ্য উপভোগ করা যায়, আর সারাক্ষণ গান শোনার বদলে মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়।'

সেই সফরে তমা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বন্ধু আর স্মৃতি সংগ্রহ করেছিলেন। সাধারণ স্মারকের পাশাপাশি সঙ্গে করে এনেছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ জীবনবোধ।

যারা প্রযুক্তির ওপর একটু বেশি নির্ভরশীল, তাদের জন্য ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করাই হতে পারে সহজ উপায়। শুরু করুন মাত্র আধঘণ্টা সময় দিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে দিনে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় বাড়ান। দিনের বিভিন্ন সময়ে এই সময়গুলো ব্যবহার করুন। যেমন: দিনের প্রথম আধঘণ্টা, ঘুমাতে যাওয়ার আগের শেষ আধঘণ্টা ইত্যাদি। এতে আপনি অনেক সময় খুঁজে পাবেন। পাশাপাশি বন্ধু ও সহকর্মীদের জানিয়ে দিন যে আপনি ডিজিটাল ডিটক্সের চেষ্টা করছেন, যাতে তারা বুঝতে পারে যে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আপনাকে বিরক্ত না করাই ভালো।

প্রযুক্তির ওপর অতিনির্ভরশীলতা থেকে বিরতি নেবেন যেভাবে
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ/স্টার

তবে বিষয়টি শুনতে যত সহজ লাগে, বাস্তবে ততটা সহজ নাও হতে পারে। যাতায়াতের জন্য রাইড শেয়ার করা থেকে শুরু করে খাবার ও বাজার অর্ডার দেওয়া, আবহাওয়ার খবর জানা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে রাখাসহ প্রায় সবকিছুর জন্যই আমরা ফোনের ওপর নির্ভরশীল। গৃহিণী রাশিদা রাইমিন বলেন, 'প্রযুক্তিমুক্ত হওয়ার পথে প্রথম পা রাখাটা সত্যিই ভয়ংকর ছিল। নিজেকে একেবারে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হতো। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর ফোন ধরতে ইচ্ছে করত। মনোযোগ ধরে রাখতে ফোনটা একেবারে চোখের আড়ালে ড্রয়ারে রেখে দিতে হয়েছিল।' ফোনের কথা ভুলে থাকতে তিনি বুনন (নিটিং) শুরু করেন, আর এখন টানা কয়েক ঘণ্টা ফোন না দেখেও দিব্যি থাকতে পারেন।

প্রাথমিক এই চ্যালেঞ্জের পরেও প্রযুক্তিমুক্ত থাকার সুফল কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে মনোযোগ বৃদ্ধি, ভালো ঘুম এবং মানুষের সঙ্গে আরও গভীর সংযোগ। নৃত্য ও যোগব্যায়াম প্রশিক্ষক অন্নেষা রাহা বলেন, 'ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্ক্রিন স্ক্রল করা এমন এক অভ্যাস, যার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। আর বিশ্বাস করুন, এই অভ্যাস ছাড়ানো মোটেও সহজ নয়। এই কাজটা দেখতে নিরীহ মনে হলেও, ছবির রং, আলো আর শব্দ আসলে মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উদ্দীপ্ত করে তোলে।'

অন্নেষা জানান, ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তিনি পুরোপুরি ফোন বন্ধ করে দেন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘুমের রুটিনে স্পষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।

এমবিএ শিক্ষার্থী ফিদিয়া মান্নান দেখেছেন, ফোন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার ফলে তিনি এমন সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যা লিংকডইনকেও হার মানাবে। তিনি বলেন, 'ভাবতেই অবাক লাগে। চারপাশে এত জ্ঞানী ও সম্ভাবনাময় মানুষ ছিল! আর এতদিন আমি কোথায় ছিলাম? ইনস্টাগ্রামে!'

ভুল বুঝবেন না—প্রযুক্তিকে আমরা ভালোবাসি, এর উপকারিতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর হঠাৎ করেই একেবারে সব বন্ধ করে দেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি বুদ্ধিমানের কাজও নয়। তবে এখন সময় এসেছে একটু সচেতন হওয়ার, আমরা প্রযুক্তিতে কতটা সময় দিচ্ছি, কীভাবে দিচ্ছি, আর কীভাবে এই নির্ভরতা কিছুটা কমানো যায় তা নিয়ে ভাবার। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি প্রযুক্তিকে চিরতরে বাদ দেওয়ার নয়; বরং কোথায় থামবেন সেটি বুঝতে হবে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

Comments