স্ট্রাগলার সায়েম: বাস্তব জীবনে লড়াইয়ের গল্প

ঢাকা শহরের একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সায়েম আহমেদ। অবশ্য অনলাইন জোয়ারে তাকে সবাই 'স্ট্রাগলার সায়েম' নামেই চেনেন। এমন একজন অটোরিকশাচালক, যিনি তার জীবনটা সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেন কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই। নিজে নিজেই শিখেছেন ইংরেজি। এ ভাষাতেই কথা বলেন তিনি অডিয়েন্সের সঙ্গে। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার এ জীবনে সায়েমের মতো গল্পগুলো একটু থামতে শেখায়।
নিজের কথাগুলো শোনানোর জন্য সায়েমকে চিৎকার করতে হয় না। তার নম্র, চিন্তাশীল কথাবার্তা ও গলার স্বরে এমনিতেই তার বহু ভক্ত জন্মে গেছে। তার প্রতিদিনের পোস্ট করা টিকটক, ফেসবুক পোস্টগুলো দেখে বোঝা যায় যে এতে কোনো স্পেশাল ইফেক্ট বা অতিরঞ্জনের রঙ চড়ানো হয়নি। তবুও দিনদিন বেড়েই চলে সায়েমের দর্শকসংখ্যা।
সামাজিক মাধ্যমের এই জীবন শুরুর পেছনে সায়েমের একটিই চিন্তা ছিল, আর তা হচ্ছে—ইংরেজি শিক্ষা।
ভিডিও তৈরির পেছনে তার অনুপ্রেরণার গল্প জানালেন সায়েম, 'আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিখসি, কিন্তু পড়াশোনা যেহেতু বেশিদূর এগোতে পারিনি, তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি শেখাটা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। ইংরেজির কোনো কোর্সে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা বা সামর্থ্যও ছিল না। তাই আমি ভাবলাম, ভিডিও বানালে কেমন হয়?
'এভাবেই এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম। একে তো কনটেন্ট বানানো যাবে, অন্যদিকে ইংরেজি শেখাটাও হবে। এভাবেই শুরু হয় আমার কনটেন্ট তৈরির যাত্রা।'
তাই করলেন সায়েম। শুরুর দিকের কনটেন্টগুলোতে তিনি খুব নম্রভাবে তার দিনযাপনের গল্প করতেন। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় যখন তার সবুজ সিএনজিচালিত বাহনটি নিয়ে বিশ্রাম নিতেন, তখনই এসব গল্প করতেন। মানুষের নজর কেড়েছে তার ভাষা নয়, বরং বলার ভঙ্গি। অত্যন্ত আন্তরিক, সম্মানজনক এবং কোনো ধরনের ভণিতাবিহীন।
'স্ট্রাগলার সায়েম' নামটা শুধু শব্দের খেলা নয়, বরং তার জীবনের বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।
তার সহজ স্বীকারোক্তি—'ছোটবেলা থেকেই আমি স্ট্রাগল করছি। তাই নিজেকে স্ট্রাগলার বলি। আর কিছু না।'
সায়েমের ভিডিওগুলো ঠিক ভাইরাল হওয়ার মতো করে তৈরি নয়, বরং বাস্তবতার কাছাকাছি গড়নে বানানো। তার অডিয়েন্স বেশিরভাগই কমবয়সী, বাংলাদেশি শ্রমজীবী। তাদের অনেকেই সায়েমের পোস্টে কমেন্ট করেন, তার কথাগুলো নিজের বলেই মনে করেন তারা।
কনটেন্ট তৈরির শাখা-প্রশাখা
'স্ট্রাগলার সায়েম' নামে টিকটক আর ফেসবুকে সায়েম কনটেন্ট তৈরি করে থাকেন—'আমি ফেসবুক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি, তবে টিকটক বেশি ভালো লাগে। এখানে সহজে মানুষের নজরে পড়া যায়।'
এই কথাগুলো হয়তো প্রশিক্ষিত, করপোরেট ঘরানার কোনো ইনফ্লুয়েন্সারের কথা বলে মনে হয় না। তবে এটিই সায়েমের ব্যক্তিগত যাত্রা, এভাবেই তিনি তার সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেন, সহজভাবে।
সায়েমের বলা গল্পগুলো শুধু যে তার দৈনন্দিন জীবন বা ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে আসে, তা নয়। তিনি চাঁদাবাজি সমস্যা নিয়েও একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন।
চাঁদাবাজি নিয়ে সচেতনতামূলক এ ভিডিওতে সায়েম বলেছেন, 'আমি সত্যিই ভিডিও পোস্ট করে যেতে চাই, তবে আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। কেননা আমাদের দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাটাই যেন অপরাধ। এক ধরনের অভিশাপ। আর বর্তমানে আমার পরিবারে আমিই একমাত্র পুরুষ। আমার মনে হয়, যারা বোঝার—তারা এমনিতেই বুঝবেন।'
বাস্তবতার আলিঙ্গন
অনলাইনে বেশিরভাগ বিষয়ই বাস্তবের চাইতে বেশি সাজানো। কিন্তু সায়েম ভান করেন না। তার বোনের সঙ্গে সিঙ্গেল বার্নার চুলায় ভাত রাঁধা, হাসিতে গড়িয়ে পড়া বা অটোরিকশায় বসে থাকা চুপচাপ কিছু মুহূর্তকে দেখে জীবনের খুব কাছের বলে মনে হয়। তাই তো স্ক্রল করে সরে যাওয়ার পরও মনে থেকে যায় সায়েমকে। যে তরুণরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নন, অথচ জীবনের লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে চান, দায়িত্বের ভারে যাদের কাঁধ ন্যুব্জ—সেই তরুণদের জন্য সায়েম এক অনুপ্রেরণার নাম। সায়েমকে দেখে বোঝা যায়, মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে নিজের সততা আর নম্রতাই যথেষ্ট।
কোনো ট্রাইপড, লাইটিং বা স্ক্রিপ্ট ছাড়াই তিনি শ্যুটিং করেন। কিন্তু তার কনটেন্ট দেখে মোটেও আনকোরা মনে হয় না। বরং তার কাজের মধ্যে থাকা সততায় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে সবকিছু। তিনি খুব সুন্দর সময়মাফিক পোস্টগুলো করেন।
আলাপের শেষে যখন তার কাছে বার্তা চাওয়া হয়, তখন তিনি বললেন, 'নো, থ্যাংকস'। বোধহয় এই বিষয়গুলোই সায়েমকে আলাদা করে। কারণ তিনি কখনো উপদেশ দিতে চান না, কাউকে কিছু শেখাতে চান না। তিনি শুধু নিজের মতো করে, জীবনের সবুজ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments