জন্ম না দিয়েও মা যারা, তাদেরকেও মা দিবসের শুভেচ্ছা

মা দিবস
ছবি: সংগৃহীত

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপিত হয় মা দিবস। পুঁজিবাদী সমাজের নানা দিবসের মতো এ দিবসকে নিয়ে সমালোচনা থাকলেও, মায়েদের জন্য বিশেষ কোনো দিন থাকাটা আমার চোখে মন্দ লাগে না।

সময়ের সঙ্গে মা দিবসেরও নানা পরিবর্তন এসেছে, বেড়েছে এর পরিধি। এখন মা দিবসকে অনেকেই শুধু 'বায়োলজিক্যাল মাদার' এই ধারণায় সীমিত করতে চান না। আসলেই তো, মা কি শুধু রক্তের সম্পর্ক? মূল বিষয় যদি হয় মায়ের দায়িত্বশীলতা, স্নেহ, একটি অনুভব, তাহলে সে হিসেবে একজন মা হতে পারেন দত্তক নেওয়া কোনো সন্তানের অভিভাবক, সিঙ্গেল প্যারেন্ট কিংবা এমন কোনো নারী, যিনি প্রকৃত মায়ের অনুপস্থিতিতে কাউকে নিজের স্নেহে গড়ে তোলেন।

মা হওয়া মানে একজন নারী যখন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা দেন, আগলে রাখেন, সাহস দেন, আর কারও জীবন গড়ে দিতে নিজেকে বিলিয়ে দেন। সেই নারীও মা, যদিও তিনি বায়োলজিক্যাল মা নন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, আমার ভাগ্নেকে সেই তিন মাস বয়স থেকে বড় করেছি একেবারে নিজের ছেলের মতো করেই। কখনো মনে হয়েছে, ওর নিজ মায়ের থেকেও হয়তো আমি আর আমার মা তাকে বেশি আগলে রেখেছি। স্কুলে দিয়ে আসা, কী খেতে পছন্দ করে, ক্যান্টিনের ভিড়ে টিফিন কিনতে পারল কি না সব নিয়েই আমার চিন্তা। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়েছিলাম। ওই সময়টাও একদিনও এমন হয়নি, ওর খোঁজ নিইনি। দায়িত্ব তো আছেই, কিন্তু এর সঙ্গে এখানে জুড়ে যায় আসলে এক ধরনের মায়া। আমার ভাগ্নে এখন বলে, আমিও তার মা।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বন্ধু ছিলেন। তিনি নিজে যদিও স্বেচ্ছায় মাতৃত্ব নেননি, কিন্তু ফুপু হিসেবে স্নেহ এবং দায়িত্ব নিয়ে এই শিশুটিকে দেখভাল করতেন। মাঝেমধ্যেই বলতেন, 'আমি তো ওর মা হই, তাই না?'

আসলে খোলা চোখে দেখলে মা দিবসের এই বিস্তৃত সংজ্ঞায়ন তেমন কোনো পার্থক্য তুলে ধরে না। গর্ভধারণ করার যে সময়টুকু বা তার আগেকার যে প্রস্তুতি, সেটিকেও বাদ দিলে চলে না। তবে পুঁজিবাদী এবং একইসঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে 'মা' শব্দটি দিয়ে আমরা অনেক সময়েই নারীর ওপর এক ধরনের দায়িত্ব, কিছু নির্দিষ্ট আচরণ আরোপ করি। অবশ্যই যিনি মা হবেন, তাকে দায়িত্বশীল এবং একইসঙ্গে স্নেহশীল হতে হবে। কিন্তু এ বিষয়টি একজন বাবার ক্ষেত্রেও খাটে। সমাজ বদলেছে, সেইসঙ্গে বদলেছে আমাদের জীবনধারা। পরিবর্তনশীল সমাজে আপনাকে সেই পরিবর্তনের সঙ্গেই এগোতে হবে।

বর্তমানে নারীরাও পুরুষের মতোই নিজ পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। অনেকেই পরিবার শুরু করেন সময় নিয়ে। আমার সিনিয়র অনেককেই দেখেছি, বিয়ে করেননি মা-বাবা এবং ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে বলে। তাই মাতৃত্ব বিষয়টি অনেক নারীর কাছেই একটি সিদ্ধান্ত বা চয়েস, কোনো অবধারিত বিষয় নয়। নারী মাত্রই একজন মানুষ সর্বোপরি। নারীকে পরিপূর্ণতা পেতে হবে সংসার এবং মাতৃত্ব দিয়ে, এমন নয়। একইসঙ্গে একজন নারী মা হলেই যে তাকে সবসময় সন্তান এবং পরিবারের জন্য তার নিজের মনোজগত, স্বপ্ন ছেড়ে দিতে হবে এমনটাও নয়। আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই 'পোস্টপ্যারটাম ডিপ্রেশন' কিংবা মাতৃত্বকালীন সময়টুকুতে যে মানসিক বিষণ্ণতা, হরমোনের বিভিন্ন জটিলতা, এসব বিষয়ে সচেতন নন।

সবার আগে একজন মানুষ নিজে যদি সুস্থ থাকেন, তাহলেই সতিনি অন্য আরেকজন মানুষকে গড়ে তুলতে পারবেন ভালবাসা এবং দায়িত্বশীলতায়। আবার এমনও বহু নারী আছেন, যারা মাতৃত্ব থেকে 'বঞ্চিত' হয়ে নিজেদের দায়ী করেন, আর সমাজও তাদের ওপর দায় চাপায়। কিন্তু মা হয়ে উঠতে জন্ম দেওয়াটাই একমাত্র বিষয় না।

অনেক শিক্ষিকা, আশ্রমের কর্মীকেও একজন শিশুর জীবন গঠনে মার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি আমরা। তারা হয়তো কখনো মা ডাকটা শোনেন না, কিন্তু তাদের দেওয়া স্নেহ, দিকনির্দেশনা আর ভালোবাসা একজন মানুষকে গড়ে তোলে। তাই আজকের দিনে শুধু নিজের মাকেই নয়, তাদের কথাও স্মরণ করি, যারা 'মা' শব্দটিকে নতুন অর্থ দিয়েছেন। যারা প্রমাণ করেছেন, মা হওয়া মানে শুধু জন্ম দেওয়া নয়, বরং জন্মের পর একজনকে গড়ে তোলার, আগলে রাখার শক্তি।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)।

 

Comments

The Daily Star  | English
government

Govt to act with people’s backing if blocked from responsibilities: Advisory council

"The Advisory Council believes that a broader unity is essential to maintain national stability"

24m ago